বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

আওয়ামী লীগ সরকার কি এখনও সুবিবেচক হবে



আ তা উ স সা মা দ
জুন মাসের অর্ধেক পার হয়ে গেল কিন্তু ঢাকা শহরে আমরা বৃষ্টির জন্য কাতর হয়ে অপেক্ষা করছি। আবহাওয়া দফতরের আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বর্ষার শুরু। তার আগেই মে মাসের শেষভাগেও দু’চার দফা ভারী বর্ষণ হয় মাঝে মাঝে। এবার ঢাকায় সেই সময় বৃষ্টির একটু ভাব ছিল আর ছিল ঝড়ো হাওয়া। তবে জুন মাসের এ পর্যন্ত ছিল না বৃষ্টি, আছে দম বন্ধ করে আনা গরম। আর সেই সঙ্গে আছে হাওয়ায় ধুলার স্তর এবং এক ঘণ্টা পরপর বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হলেই সচল হয়ে ওঠা হাজার হাজার জেনারেটরের বাতাস ভারী করা বিশ্রী আওয়াজ। ঢাকা শহর ঘিরে যত ইটের ভাটা আছে, সেগুলোর ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে ভাসতে থাকে সেখানকার ধুলা। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, প্রায় বছর খানেক ধরে রাজধানী ঢাকার আকাশে দিনরাত সকল সময়েই যে একটা ধূসর আবরণ দেখা যায়, তা মূলত এই ধোঁয়া ও ধুলার তৈরি। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাস্তাঘাটের ধুলা। প্রায় পুরো ঢাকা শহরজুড়ে এবার শুকনো মৌসুমে মহাসড়ক ও মাঝারি সড়ক, গভীর করে খোঁড়া হয়েছিল নানান রকম পাইপ বসাবার জন্য। সেসব গর্তের অনেকগুলো ফের মাটি দিয়ে ভরাট করলেও বেশ কিছুতে এখনও কাজ চলছে। তবে এসব সড়কই এখন মাটির কাঁচা রাস্তার রূপ ধারণ করেছে, কারণ এগুলো আবার পাকা করা সম্ভব হয়নি। যেখানে যেখানে ভরাট করা হয়েছে, সেখানে বালু আর মাটি এখনও জমাট বেঁধে বসেনি। কাজেই সেসব জায়গায় ঢালাই বা পিচ করার কাজ করা সম্ভব নয়। এসব কাটা-ভাঙা রাস্তা থেকেও খুব ধুলা হয়। খোঁড়াখুঁড়ি করা রাজধানীর এসব পথঘাটের অধিকাংশ পানি ও কাদায় ভরা বিপজ্জনক খানাখন্দে পরিণত হবে। তবু আমরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছি যাতে আমাদের নিঃশ্বাস নেয়ার বাতাসটা নির্মল হয়, যাতে প্রাণ-ওষ্ঠাগত করে আনা গ্রীষ্মের উত্তাপ কিছুটা হলেও কমে আসে।
আমরা দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও তাপ এবং ধুলার প্রবাহ কমে আসার জন্য অপেক্ষা করছি। গত ১১ জুন, সোমবার, সরকার-বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের বিশাল গণসমাবেশে বিএনপি’র চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারকে আবারও আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার ব্যবস্থা নিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে ১৯৯৬ সাল থেকে চলে আসা এই ব্যবস্থা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তুলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটভুক্ত সংসদ সদস্যরা। এই পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রতিবাদ করে আসছে বিএনপি শুরু থেকেই। বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোট চেয়েছিল ক্ষমতাসীন দল ১০ জুনের মধ্যে পুরনো ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে তাদের সম্মতি ঘোষণা করুক। কিন্তু তা হয়নি। অবশ্য রমজান ও ঈদ সামনে রেখে ১৮ দলীয় জোট দেশে কোনো হাঙ্গামা বা বিশৃঙ্খলা চায় না বলে তাদের দাবি আদায়ের জন্য আপাতত কোনো ‘কঠোর কর্মসূচি’ দেয়া থেকে বিরত হয়েছে। তবে গত সোমবারের গণসমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করলে ঈদুল ফিতরের পর থেকেই হরতাল ও অবরোধ এমনকি লাগাতার হরতাল বা অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে কঠিন আন্দোলন শুরু করবেন। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দলের সংসদীয় কমিটির সভায় তাঁর দলের সংসদ সদস্যদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, সংশোধিত সংবিধানের ব্যবস্থা মোতাবেক ২৫ অক্টোবর ২০১৩ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে এবং সেই নির্বাচন হতে হবে ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের মধ্যে। ওই নির্বাচন হবে এই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই বলে জানিয়েছেন তিনি। অর্থাত্ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনার শাসনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, একথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন তিনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কার অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে সেই প্রশ্নে সরকারি জোট ও বিরোধী জোট একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। এর ফলে রোজার ঈদের পর বাংলাদেশে একটা প্রচণ্ড উত্তেজনাকর ও দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এরকম অবস্থা আমরা চাই না। তবে এটা এড়ানো কঠিন; কারণ, বর্তমান ব্যবস্থায় বাংলাদেশে সরকার গঠন করবে সেই দল বা জোট যারা জাতীয় সংসদের সংখ্যাগুরু আসনে নির্বাচিত হবে। সোজা কথা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার নির্বাচন। আর এখনকার পরিস্থিতি হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনের সময় সর্বোচ্চ ‘সুবিধা’ পাওয়ার জন্য তখনও ক্ষমতায় থাকতে চায় আর বিএনপি ও তার বিরোধীদলীয় জোট সরকারি দলের কারচুপি ও পেশিশক্তির ভোট এবং সাজানো ফল ঘোষণার ফাঁদে পা দিয়ে ঠকতে চায় না বলে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ বা কোনো দলকে সরকার চালাতে দিতে চায় না। তাই বিরোধী দলের দাবি—উঠিয়ে দেয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের জন্য সঠিক এবং সুবিবেচনার কাজ হবে অবিলম্বে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃসংযোজন করা এবং এখনই দেশের মানুষকে জানিয়ে দেয়া যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেশের দায়িত্বে থাকবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমরা এমন কথাটি বলছি ভূমিতে বিরাজমান পরিস্থিতি (ড়হ ঃযব মত্ড়ঁহফ ংরঃঁধঃরড়হ) পর্যালোচনা করে। সংক্ষেপে সেই পরিস্থিতির বিবরণ দিই। এক. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দাবি করছেন এবং তাঁর দলও বলে চলেছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী। সেই এক ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়েছিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা দেশের সংবিধানসম্মত নয়। তাই এটা তুলে দিতে হবে। তবে দেশের অবস্থা বিবেচনায় এই ব্যবস্থা আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বলবত রাখা যেতে পারে। কিন্তু কোনো বিচারপতিকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সংবিধান উপদেষ্টারা এই রায়ের শুধু প্রথম ভাগটিকে (অর্থাত্ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে অংশটি) আদালতের আদেশ বা হুকুম হিসেবে বর্ণনা করে সেটুকুই কার্যকর করেছেন। রায়ের বাকি অংশটুকু (আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে) সম্পর্কে তাঁদের দাবি হলো—এটা আদালতের পর্যবেক্ষণ মাত্র, আদেশ নয়। বিরোধী দলগুলো এবং প্রবীণ আইনজীবীরা অন্যদিকে দাবি করে আসছেন যে, পুরো রায়টিই আদেশ। এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক অতিসম্প্রতি বাংলাভিশন টেলিভিশনের সঙ্গে এক টেলিফোন সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ওই রায়ের দুটি অংশই আদেশ অর্থাত্ আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখে দেয়ার কথাটিও ‘আদালতের হুকুম’, ওটা পর্যবেক্ষণ বা সুপারিশ নয়। উল্লেখ্য, বিচারপতি খায়রুল হক ওই রায় দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং তিনিই রায়টি ঘোষণা করেছিলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সর্বশেষ মন্তব্যের পর আর কারও পক্ষে এ দাবি করা চলে না যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না রাখা সম্পর্কে তাঁদের দেয়া রায়ের কেবল প্রথম অংশ কার্যকর করতে হবে আর দ্বিতীয় অংশ গ্রাহ্য না করলেও চলে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, তা হলো—বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন, তিনি এখন থেকে দুই মাস আগে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায়টি সুপ্রিমকোর্টে জমা দিয়েছেন। সেটি এতদিনেও প্রকাশিত না হওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। জনগণও সেই পূর্ণাঙ্গ রায়টি দেখতে আগ্রহী। আশা করি, এটি অচিরেই প্রকাশ করা হবে। তবে একথা এখনই বলা যায়, শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেয়ার জন্য তিনি ও ক্ষমতাসীনরা যে আইনি যুক্তি দেখিয়েছেন, তার ভিত্তি আর বিদ্যমান নেই। তাই পুরো রায় অনুযায়ী সংবিধান পুনরায় সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এখন তাঁদের জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। এক্ষেত্রে সংসদকে একটাই নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিমকোর্টের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে যেহেতু নিয়োগ দেয়া যাবে না, সেক্ষেত্রে এই পদটি কীভাবে পূরণ করা হবে? জাতীয় সংসদই আলোচনা করে প্রক্রিয়াটি ঠিক করে দিতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিবেচ্য হলো, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানান রকম সন্ত্রাসী ও সহিংস কর্মকাণ্ড করে চলেছে তারা এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। তাদের সন্ত্রাসের সর্বশেষ উদাহরণ, সুপ্রিমকোর্টের জমিতে অবস্থিত সড়ক ভবনে গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের লোকেরা টেন্ডার দখল নিয়ে প্রকাশ্যে গোলাগুলি করে পাঁচজনকে ঘায়েল করে। ওই সময় পুলিশ বা আনসারের সশস্ত্র কোনো প্রহরীকে সেখানে দেখা যায়নি, যদিও বলিউডি ফিল্মের কায়দায় তারা হাজির হয় ওই দলীয় সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পরপরই। দ্বিতীয় উদাহরণ পুলিশকে নিয়ে। আওয়ামী দলীয়কৃত পুলিশ কোনো আইনকানুন মানে না। তাদের একদল ঝিনাইদহের এক গ্রামে আবদুল ওয়াহাব নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে রাতের আঁধারে হানা দিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। তৃতীয় উদাহরণ, গত সোমবার ঢাকায় বিরোধী ১৮-দলীয় জোটের গণসমাবেশে যাতে মানুষ যোগ না দিতে পারে, সেজন্য সরকারের নির্দেশে বাইরে থেকে ঢাকায় বাস ও লঞ্চ আসা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তারা শ’য়ে শ’য়ে লোকজনকে গ্রেফতার করে। আর আওয়ামী ক্যাডাররা লাল জামা পরে লাঠিহাতে বুড়িগঙ্গায় নৌকার যাত্রীদের পিটিয়ে ঢাকায় আসা থেকে বিরত করার চেষ্টা করে। টঙ্গীতে এরকম ক্যাডাররা লগি দিয়ে ট্রেনযাত্রীদের পিটিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়। অতএব একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আওয়ামী লীগদলীয় সন্ত্রাসীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের গুণ্ডামার্কা বা অপরাধপ্রবণ মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচিত করার জন্য ভোটারদের ওপর তথা সাধারণ জনগণের ওপর এরকম সশস্ত্র ও সহিংস হামলা চালাবে। পুলিশ তাদের বাধা দেবে না; বরঞ্চ পুলিশ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও গ্রেফতার করবে, যেমন করছে বর্তমানে। ফলে নির্বাচনটি হবে একটি প্রহসন। এখনই বাংলাদেশে সুশাসন বলে কিছু নেই। তখন সুশাসনের কবর হয়ে যাবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দেশের ওপর থেকে সন্ত্রাসী-শাসন তুলে নিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে দেশের মানুষ খুশি হবে এবং এতে আখেরে আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও লাভবান হবে।
বাস্তবতা ভিন্ন। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের অসাংবিধানিক সরকারের অধীনে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র ভরাডুবি হয়। আর আওয়ামী লীগ পায় বিস্ময়কর সাফল্য। ১/১১’র জরুরি আইনের অত্যাচারী অসাংবিধানিক সরকারের হাতে লাগাতার নির্যাতিত হওয়ার পর নির্বাচনে অতি সামান্য সংখ্যক আসন পাওয়ায় অনেকেই মনে করেছিলেন, বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এ নিয়ে হাসি-তামাশাও করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত সাড়ে তিন বছরে বিএনপি তার অস্তিত্ব ভালোমতই টিকিয়ে রেখেছে। দলটি যে চাইলে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে পারবে সেটাও প্রমাণ করেছে। বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী প্রায় তিন মাস আগে তাঁর গাড়ির চালকসহ মাঝরাতে তাঁর বনানীর বাড়ির কাছের রাস্তা থেকে গুম হওয়ার পর দলটি পরপর পাঁচদিন হরতাল করেছে। হরতালের সময় একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগকে ছুতা করে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও প্রথম কাতারের অনেক নেতাকে সরকার গ্রেফতার করে আটক রেখেছে। তাঁদের দ্রুত বিচার আদালতে তোলা হচ্ছে। তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করার পর সরকার নানান আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে তাঁদের আটক রেখেছে। আওয়ামী লীগ হয়তো ভেবেছিল, বিএনপি’র নেতাদের আটক রাখলে ও কর্মীদের ভয়ভীতি দেখালে ১৮-দলীয় জোটের ১১ জুনের গণসমাবেশ ব্যর্থ হবে। কিন্তু বিএনপি’র সমর্থকরা পুলিশের বেআইনি বাধা, গণগ্রেফতার ও আওয়ামী সমর্থক সন্ত্রাসীদের হাতে মারধর সহ্য করেও গণসমাবেশ খুব ভালোভাবেই সফল করেছে। এর আগে ১২ মার্চের ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচিও তারা একইভাবে সফল করেছিল সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। এসবের ফলে বেশিরভাগ মানুষ মনে করবেন, বিএনপি ও তার ১৮-দলীয় জোট আগামীতে কঠিন কর্মসূচি দিলে তা পালিত হবে। সরকার অনমনীয় থাকলে সে ক্ষেত্রে দেশে অশান্তি ও নিপীড়ন-নির্যাতন বাড়বে। জনগণ তা পছন্দ করবে না। তাই এক্ষেত্রেও সরকারের জন্য সুবিবেচনার কাজ হবে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পথ থেকে সরে আসা। আর তার উপায় হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংশোধিত রূপে পুনঃপ্রবর্তন করা।

সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

সকলেই শুধায়, কেমন আছি আমরা



আ তা উ স সা মা দ
ঘরের বাইরে গেলেই কেউ না কেউ প্রশ্ন করেন, ‘দেশের অবস্থা কেমন? কী হচ্ছে দেশে?’ আমিও যাদের ওয়াকিবহাল বলে মনে করি তাদের কারও সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করি, ‘আমরা কেমন অবস্থায় আছি? কোন দিকে যাচ্ছি?’ বাস্তবত এখন প্রায় সবাই অন্য সবাইকে এই একই প্রশ্ন করছেন। ‘প্রায় সবাই’ কথাটি ব্যবহার করলাম এ কারণে যে, যারা ক্ষমতায় আছেন, সরকার চালাচ্ছেন, সবাইকে হুকুম করে বেড়াতে পারেন এবং নানান সরকারি সুবিধা নিজেরা ভোগ করেন এবং নিজের খাতিরের লোকদের মধ্যে তা বিলি করেন—তারা ভালোই আছেন। তারা এও মনে করেন যে, দেশটাও তাদের মতোই ভালো আছে। তাই তারা সারাক্ষণই উচ্চকণ্ঠে বলে চলেছেন যে, দেশের মানুষ খুব ভালো আছে এবং তাদের অবস্থা দিন দিন আরও ভালো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইদানীং বলেছেন, সরকারের যারা সমালোচক, যারা নিন্দুক, তারা নগরভিত্তিক কিছু সমস্যার নজির দেখিয়ে বলেন, দেশের অবস্থা ভালো নেই, কিন্তু তারা গ্রামে গিয়ে দেখে না যে সেখানকার মানুষ কত সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। ইদানীং রাজধানী ঢাকা ও দেশের আরও অনেক জায়গায় কখনও পুলিশ আর কখনও ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ও অন্য নেতাদের নির্দেশে তাদের পেটোয়া বাহিনী সাংবাদিকদের ওপর অকথ্য শরীরিক নির্যাতন করার পর সমালোচনার ঝড় উঠলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী মন্তব্য করেছেন যে, সাংবাদিকরা আগের চেয়ে ভালো আছেন। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় অনলাইন মতামত জরিপে বেশির ভাগ মতদানকারী (১৩৩৮ জনের মধ্যে ৫৮.৪৫%) তার মন্তব্য সঠিক বলে অভিহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন যে, সাংবাদিকরা আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছেন, তারা স্বাধীনভাবে লেখালেখি করছেন। তিনি এও বলেছেন যে, সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকের পেটের ভাত হজম হয় না সরকারের সমালোচনা করে কিছু না লিখলে। তিনি এও অভিযোগ করেছেন যে, রোজই তিনি এমন কিছু খবর পড়েন যেগুলো ভুল অথবা যেগুলো খোঁজখবর নিয়ে লেখা হয়নি।
দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে প্রতিদিন যত খবর প্রকাশিত হয় বা সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হয় তার প্রত্যেকটিই একেবারে নিখুঁত বা সঠিক তথ্যনির্ভর এমন দাবি আমিও করি না। কিন্তু এটুকু বলব যে, বেশিরভাগ খবরই সঠিক তথ্যনির্ভর হয়। মতামত যারা দেন তাদের কথা একটু ভিন্ন, কারণ তারা যা ভালো মনে করেন তাই বলেন। সংবিধানে সেই স্বাধীনতা দেয়া আছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, এসব ক্ষেত্রে সরকার-সমর্থকরা তাদের মন্তব্যে বিরোধী দলগুলোকে তুলোধুনো করেন, বিরোধীরা তাদের যতখানি সমালোচনা করেন তার সমানই অথবা কিছুটা বেশি। প্রধানমন্ত্রী বা তার মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা এই সত্যটা এড়িয়ে যান। এক্ষেত্রে তাদের নজরে বস্তুনিষ্ঠতার সংজ্ঞা অক্লেশে পাল্টে যায়। আর আমাদের মুশকিলটা হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা মেনে নিন বা না নিন সাংবাদিকদের মাথায়, মুখে, পিঠে লাঠির ঘায়ের দাগ ও পুলিশের সবুট লাথি খাবার অপমানে মনের ভেতর যে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তাতো বাস্তবিক, ওগুলো তো কাল্পনিক নয়।
এসব কথা লিখছি বলে কেউ সমালোচনা করতে পারেন যে, পুরনো গীতই গেয়ে চলেছি। আসলে তা নয়। পুরনো আঘাতের ব্যথাটার ওপর লাঠির বাড়ি নতুন করে পড়েছে বলে যন্ত্রণায় বেশি কাতর হয়ে পড়েছি আমরা। এই সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো চলমান বিভীষিকার সঙ্গে যোগ হয়েছে গুম আতঙ্ক। কোনো কোনো সাংবাদিক একটু সাহস করে সমাধান হয় নাই এমন রহস্য নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজের বা স্বজনের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার হুমকি পাচ্ছেন কর্কশ কণ্ঠধারীদের কাছ থেকে ফোনে। আর গতকালই আমার দেশ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে, গোবিন্দগঞ্জে সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম জয় ১০ দিন ধরে নিখোঁজ আছেন। যেদিন থেকে তার খোঁজ নেই সেদিনই তিনি আগে একবার সন্ত্রাসীদের হামলায় পড়েছিলেন। দোয়া করতে থাকব তিনি যেন অচিরেই সুস্থদেহে ফেরত আসেন। তবে আমাদের এসব কান্নাকাটি যাতে কেউ অহেতুক মনে না করেন সেজন্য সবার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার-এর ২০১১-১২ সালের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রিপোর্টের দিকে। এই রিপোর্টে ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিক থেকে ১২৯ নম্বরে। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে নেমে গেছে। উল্লেখ্য, গত ২০১০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল উপর থেকে ১২৬ নম্বরে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে দেশের ভেতরে যেহেতু দুটি ভিন্ন মতের অস্তিত্ব রয়েছে সে জন্য তৃতীয় একটি পক্ষের মতামত হিসেবে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (RSF)-এর প্রতিবেদন উল্লেখ করলাম। অবশ্য আজকের এ লেখায় এই প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে দেশের ভেতরের অপর একটি অভিমত উল্লেখ করি, কারণ এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এই অভিমতটি শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক এবিএম মূসার, যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে এবং অসুস্থতার মাঝেও গণমাধ্যমে দেশের নানা সমস্যা সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ ও মত দিয়ে চলেছেন। কিছুকাল আগে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, এখন লেখার ও বলার স্বাধীনতা আছে কিন্তু সংবাদ বা মন্তব্যটি প্রকাশিত হওয়ার পরদিন প্রতিবেদক বা ভাষ্যকারের যে কী হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
আর মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। দেশের অর্থনীতিতে কিছু সমস্যা থাকার কথা। অর্থনীতি কিছুটা চাপে পড়ার ব্যাপারটা তিনি এরই মধ্যে স্বীকার করেছেন, কিন্তু তবুও তিনি বলবেন, দেশ এগিয়ে চলেছে, বিশ্বমন্দার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হলেও যতখানি হয়েছে তা প্রশংসনীয়। বিশ্বব্যাংকও ভালো-মন্দ মিলিয়ে কিছু বলেছে। তারা মন্তব্য করেছে, বিশ্বমন্দার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়, তবে তা এশীয় গড় প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম।
অর্থনীতির পরিসংখ্যানগত হিসাব-নিকাশ যাই হোক না কেন, আমজনতা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করবে তারা কতটুকু আয় করতে পারছে আর জীবনযাত্রার জন্য তাদের কত ব্যয় করতে হচ্ছে। কথায় বলে, পেটে খেলে পিঠে সয়। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, পেটে যথেষ্ট পড়ছে না। খরচ যত বেড়েছে আয় তত বাড়েনি। খরচের মধ্যে কেবল খাদ্যের দাম নয় সেই সঙ্গে চিকিত্সা, যাতায়াত, বস্ত্র, আশ্রয় ও শিক্ষার জন্য যা ব্যয় হয় সেটাও ধরতেই হয়। এই অতি সম্প্রতি খাদ্যসামগ্রীর দাম নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে আর বাড়িভাড়া, চিকিত্সা, যাতায়াত খরচ এবং শিক্ষার ব্যয়ও বেড়েছে। জীবনযাত্রা নিয়ে উত্কণ্ঠার সীমা নেই। কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় নতুন ও পুরাতন দুই শ্রেণীর বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি আসলে আদৌ স্বস্তিদায়ক নয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে প্রকাশিত UNDP’র মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনটি স্মরণ করা যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বের ২০১টি দেশের মধ্যে ওপর দিক থেকে ১৪৬তম, বলা যায়, তলানির দিকেই। ওই প্রতিবেদনে দিনে মার্কিন ১ ডলার ২৫ সেন্ট-এর চেয়ে কম আয় বাংলাদেশে এমন লোকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৯.৬ ভাগ অর্থাত্ প্রায় অর্ধেক। চারদিকের অবস্থা দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে গত কয়েক মাসে।
এদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্ব চলছে। জেল-জুলুম, জেলগেটে পুনরায় গ্রেফতার—এসব চলছেই। সঙ্গে চলছে সংলাপ-সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, যা এখনও মনে হয় নাটক বা প্রহসন। সামগ্রিকভাবে এই অবস্থায় আতঙ্কিত জনগণ তো স্বাভাবিকভাবেই একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করবে, ‘কেমন আছি আমরা, কোথায় যাচ্ছি?’