বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

যৌথবিবৃতি: বিদেশ যেতে বাধা দান করে দমনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

আতাউস সামাদ ও ফরহাদ মজহার
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিনকে দিয়ে জরুরী আইনের শাসন জারী করিয়ে যে অনির্বাচিত সরকার অসাংবিধানিকভাবে পরবর্তী দুই বছর দেশ শাসন করে তারা জনগণের মৌলিক অধিকার,মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকার লুপ্ত করেছিলেন। এই শাসকরা একদিকে নানান পন্থায় দেশজুড়ে ত্রাসের সঞ্চার করেন এবং অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহনন ও তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। তত্ত্বাবধায়ক নামধারী ঐ অসাংবিধানিক শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল যে ভয় পেয়ে জনগণ যেন প্রতিবাদী না হয়ে ওঠেন এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও যেন তাদের নেতৃত্ব দিতে না পারেন। আমরা সেই অন্ধকার দিনগুলি পিছনে ফেলে এসেছি।
কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তথাকথিত ১/১১ সরকারকে বিদায় দিয়ে দেশের যে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটিও ঐ অসাংবিধানিক সরকারের কিছু অবৈধ কর্মকান্ডের ধারা উৎসাহের সাথে অব্যাহত রেখেছে যেন এসব তাঁদের গৌরবময় উত্তরাধিকার। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার, জামিন পেতে বাধা দেওয়া ও সেজন্য আদালতকে মিথ্যা তথ্য দান, রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার, সভা-সম্মেলন বাধা দিয়ে পণ্ড করা এবং মুক্তভাবে চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধবাদীদের বিদেশ যেতে বাধা দান। এই শেষোক্ত বিষয়টি এখন বাংলাদেশিদের জন্য, অর্থাৎ এদেশের নাগরিকদের জন্য মারাত্মক হয়রানি ও গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের কারণে পরিণত হয়েছে। এর একটা জঘন্য দিক হচ্ছে সরকার ক্ষমতার অবৈধ ব্যবহার করে নিরাপরাধ নাগরিকদেরকে কোন কারণ না দেখিয়ে বিমান বন্দর বা অন্য বহির্গমন পথ থেকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদেরকে মানসিক, শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে চিত্রিত করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করছে। একই সাথে সরকারে অবস্থানকারী কিছু ব্যক্তি পর্দার অন্তরালে অবস্থান করে এভাবে সংবিধান লংঘন করে নিজেদেরকে দিনে দিনে অধিকতর বলদর্পী করে তুলছেন এবং দেশে গণতন্ত্র, নিয়মতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকি হয়ে উঠছেন। আমরা সরকারকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই যে, এসব কুকাণ্ড এখনই বন্ধ করা উচিৎ।
আমরা জনগণের সুবিধার জন্য এখানে সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি: “জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে”। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের (Universal Declaration of Human Rights) অনুচ্ছেদ ১৩(২)বলছে, “প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজের দেশসহ যে কোন দেশ ত্যাগ করার এবং নিজের দেশে প্রত্যাবর্তন করবার অধিকার রয়েছে’। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের (International Covenant on Civil and Political Rights) ১২(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “প্রতিটি ব্যক্তি নিজের দেশসহ যে কোন দেশ ত্যাগ করবার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে” এবং ১২(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “নিজের দেশে প্রত্যাবর্তন করবার ক্ষেত্রে কাউকেই খামখেয়ালী কায়দায় বঞ্চিত করা যাবে না”। আমরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ এই সকল আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং এই সকল অনুচ্ছেদের নির্দেশ অতএব মানতে বাধ্য।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে বাধা দিয়েছিল তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংবিধান ও এই সব সনদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকেই এই আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সনদগুলো আমাদেরকে শুধু দেশের ভিতরে চলাফেরা করার স্বাধীনতাই দেয় নাই, বিদেশে যাবার এবং ফিরে আসার অধিকারও সুস্পষ্টভাবে দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য যে ‘জনস্বার্থে’ সরকার নিয়ন্ত্রণের যে ক্ষমতা পেতে পারে তা অবশ্যই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত’ ও ‘যুক্তিসঙ্গত’ হতে হবে। সেই আইন তো বলবৎ আছেই। লক্ষণীয় যে কোন নাগরিকের বিদেশ যাবার প্রস্তুতি থেকেই সরকার তার ওপর আইনসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে কারণ,দেশের বাইরে কোথাও যেতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই সরকারের কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়। কাউকে পাসপোর্ট দেবার আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তর তার সম্পর্কে পুলিশি তদন্ত করিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে নেয় যে তাকে বিদেশ ভ্রমণের ছাড়পত্রটি দেয়া যাবে। আর পাসপোর্ট পেলেই বিদেশ যাওয়া যায় না। বিদেশগামী বাংলাদেশি যে দেশে বা দেশগুলিতে যাবেন তাঁকে সেসব দেশে ঢোকার ও নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করার জন্য ঐ দেশের দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। তারপর বিমান বা অন্য উপযুক্ত বাহনের টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। তাঁকে বহনকারী প্রতিষ্ঠান, যথা, কোন এয়ার লাইন, বহির্গমন বন্দরে ভ্রমণ সংক্রান্ত তাঁর সকল দলিলপত্র পরীক্ষা করে তবেই বিমান বা প্রয়োজনীয় বাহনে উঠতে দেয়। এক্ষেত্রে বিমান বন্দরে বা অন্য কোন বহির্গমন বন্দরে আমাদের ইমিগ্রেশন বিভাগের জন্য ইতিমধ্যেই পরীক্ষা হয়ে যাওয়া দলিলপত্র আবার পরখ করে দেখা,তাদের প্রয়োজনীয় কাগজটি (ইমিগ্রেশন ফর্ম) সংগ্রহ করা এবং বিদেশগামী ব্যক্তির পাসপোর্টে সিল দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। কিন্তু তারাই যখন বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকেটধারী কোন ব্যক্তিকে কোন কারণ না দেখিয়ে হুকুম করেন যে তাঁকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে তখন তাঁরা এক আঘাতে সেই ব্যক্তিটির নানান রকম ক্ষতি সাধন করেন যা করার অধিকার আইনত তাঁদের নেই। আর তাঁরা যখন বলেন যে, ওপরের নির্দেশে তাঁদেরকে দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না কিন্তু সেই নির্দেশদাতার পরিচয় দিতে পারেন না তখন তাঁরা বা সেই অতি ক্ষমতাশালী ওপরওয়ালারা বাংলাদেশকে একটি আইন অমান্যকারী অসভ্য তথা বর্বর দেশ হিসাবে বিশ্বের কাছে প্রতিভাত করেন। দুঃখের বিষয় হলো যে নাগরিকের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারের ওপর সরকারের এরকম নিপীড়নমূলক হস্তক্ষেপ উচ্চ আদালতে বারবার অবৈধ ঘোষিত হবার পরও বর্তমান সরকার এই যন্ত্রণাদায়ক, একান্ত গর্হিত ও খুবই নিন্দনীয় কার্যক্রমটি চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ইতোমধ্যে, আমরা আবার বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে নিজ নিজ পেশায় সফল অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তিদেরকে বিমান বন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁরা বর্তমানে বিরোধী দল বিএনপি’র সাথে সম্পৃক্ত। এরপরই এসেছে আরো বিস্ময়কর সংবাদ যে, সরকারের সেই অদৃশ্য উপরওয়ালারা বিমানবন্দরে ৭০ জন বিরোধী দলীয় নেতার নাম পাঠিয়েছেন যাতে এঁদেরকে বিদেশে যেতে দেওয়া না হয়। তাঁদের সাথে কয়েকজন পেশাজীবী, লেখক ও সাংবাদিকের নামও আছে যার মধ্যে আমাদের দু’জনেরও নামও যুক্ত করা হয়েছে বলে পত্রিকার রিপোর্টে আমরা দেখেছি। ঐ খবর প্রকাশিত হবার পর কয়েক দিন গত হলেও সরকারের তরফ থেকে সেটি সঠিক কি বেঠিক ঐ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রি শামসুল হক টুকু সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে এই ধরণের প্রফাইলিং সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি এই ধরনের কোন তালিকার খবর জানেন না। তিনি ব্যাপারটি দেখবেন।
এভাবে আইনের বাইরে তালিকা প্রণয়ণ করে আমাদের যে গোপন প্রফাইলিং করা হয়েছে বলে খবরকাগজ মারফত আমরা জেনেছি, তা কোন সভ্য দেশের নজির হতে পারে না। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে হুমকি ও ভয় দেখিয়ে আমাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা, আমাদের চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়া। এখানে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এর আগেও আমরা লেখালিখির জন্য অগণতান্ত্রিক সরকারের নির্যাতন ভোগ করেছি। বিগত আমলে বিনপি সরকার ১৯৯৫ সালে আনসার বিদ্রোহের ওপর লেখার কারণে ফরহাদ মজহারকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে, আদালতের নির্দেশে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
এ ব্যাপারে আমাদের প্রথম বক্তব্য হলো যে, সরকার যেন তার অবৈধ পদক্ষেপ অবিলম্বে প্রত্যাহার করে। নাহলে আমরা বিদেশ যেতে চাইলে এই ধরনের বাধা পেলে আমাদেরকে অবশ্যই আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত,যারা ঐ তালিকা তৈরি করেছেন তারা সজ্ঞানেই চেষ্টা করেছেন ক্ষমতাসীন সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, মানবাধিকার ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং ক্রমাগত সমাজ ও রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা সম্পর্কে আমাদের ইতিবাচক সমালোচনা, পর্যালোচনা ও পরামর্শ উপেক্ষা করে আমাদেরকে তাঁদের অপছন্দের রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত প্রমাণ করতে এবং মানুষকে সেভাবে বোঝাতে। এই হীন চেষ্টা আমাদের কন্ঠস্বর মলিন করে দেবার এক পুরানা কৌশল অথচ আমরা কোন দলের সদস্য নই বা কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। অতীতের অন্যান্য ক্ষমতাসীন সরকারকে আমরা যেমন সমালোচনা করেছি এই সরকারের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। সরকারের ও ক্ষমতাসীন দলের ভুল-ক্রটি-অন্যায়-অবৈধ কাজকর্মের সমালোচনা আমরা করি বলে সরকার পক্ষের আমাদেরকে বিরোধী দলের সাথে একাকার করে দিয়ে জনগণের পক্ষের লেখালেখি ও কথাবার্তাকে দুর্বল করে দেবার এই পদ্ধতি ন্যক্কারজনক। এটা করা হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে, আমাদেরকে তাঁদের সমর্থকবৃন্দের চোখে ঘৃণা ও সন্দেহের পাত্র করে তুলতে। তাঁরা ভুলে গেছেন যে, আমরা অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, অনিয়মতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক কাজের প্রতিবাদ ও সমালোচনা যখনই প্রয়োজন তখনই করেছি। তার আগে জোট সরকারের আমলে আমরা একই কাজ করেছি। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থেকে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের লক্ষ্যে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতা নিবেদিত রেখেছি এবং ভবিষ্যতেও নির্ভয়ে রাখবো।
সারা দুনিয়ার সংবাদপত্র কর্মী, সাংবাদিক, লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক এবং সর্বোপরী মানবাধিকার কর্মীদের আমরা আহ্বান জানাচ্ছি তাঁরা যেন সরকারের মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং বিদেশ গমনে বাধা দেবার জন্য তালিকা প্রণয়নের এই ঘৃণ্য তৎপরতাকে নিন্দা জানান। আমরা আশা করব লুকোচুরি না করে সরকার এই ধরণের তালিকা প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক আচরণের নজির রাখবে।

৬ আশ্বিন ১৪১৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১০। ঢাকা।

ভাল নেই বাংলাদেশের শ্রমিক


মে ১, ২০১০
দেশের জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-তে শিল্প খাতের হিস্যা অথবা অবদান বৃদ্ধি পেয়েছে, একই সাথে বেড়েছে শ্রমিকের সংখ্যা। কিন্তু পিছু হটেছে শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিকরা সেই পঞ্চাশ বছর আগে যখন এই এলাকার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান তখনকার মতো ন্যূনতম পারিশ্রমিকের দাবি তুলছেন। বেতন-ভাতা বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বৃদ্ধির হার ঠিক করা, জীবনযাত্রা সহনীয় করার জন্য চিকিৎসা সুবিধা ও সচেতন বাৎসরিক ছুটির ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি চাকরি বা কাজের নিশ্চয়তা বিধানের দাবি প্রকৃতপক্ষে আজও কথার কথা রয়ে গেছে। মে দিবস শ্রমিকদের দাবি আদায় করার সংগ্রামে রক্তদান ও প্রাণ বিসর্জনের স্মৃতিকে সম্মান দেখানোর দিন; উপলক্ষে একটা দিন ছুটি পাওয়া যাবে, কিছু লাল পতাকা উড়বে আকাশে, কয়েকটা অনুষ্ঠানও হবে কিন্তু বাংলাদেশে ঐ দিনটিতে যদি কোনো শ্রমিক উন্নতর জীবনের স্বপ্ন দেখেন তাহলে পরের দিন থেকে তাঁকে সেই কল্পনা মনের ভিতরে লালন করতে হবে। কারণ এ নিয়ে বেশি কথা বললে চাকরিটি চলে যাবে। এই মে দিবসের প্রাক্কালে দুই-চারজন শ্রমিক নেতার সাথে কথা বলে এই চিত্রটিই পেলাম।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে যে কাঁচপুর, মিরপুর ও গাজীপুরে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন, বিক্ষোভ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের খবর দেখলাম তাতে তো এই শ্রমিকদেরকে অতো দুর্বল মনে হয় না।’ তার উত্তরে শুনতে হবে: ‘ঐ শ্রমিককরা কি কোনো স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য? তারা যে আন্দোলনে নেমেছে তা কি বকেয়া বেতনভাতার জন্য নাকি পারিশ্রমিক বৃদ্ধির জন্য? আন্দোলন ছিল বকেয়া বেতনের জন্য এবং কয়েক বছর আগে সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম বেতন মাসিক ১৬৬২.৫০ (এক হাজার ছয়শত বাষট্টি টাকা পঞ্চাশ পয়সা) হারে পাবার জন্য। বকেয়া বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন তাদের পেট ও পিঠ একখানে হয়ে গেছে এবং ঘরভাড়া দিতে না পারায় যখন ঘর থেকে উৎখাত হবার জোগাড় হয়েছে কেবল তখন তারা রাস্তায় মিছিল বের করেছে।’
একই সাথে লক্ষণীয়, তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিলেই বা উত্তেজিত হয়ে কারখানায় ভাঙচুর করলেই শোনা যায় যে, এসবের পিছনে বিদেশী ষড়যন্ত্র আছে, গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করে বেকারত্ব সৃষ্টি করে এবং রপ্তানী আয় বন্ধ করে দিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। তাই শিল্পপুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করবে সরকার। একই সাথে প্রস্তাব আছে যে, শিল্প বিচার ব্যবস্থা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল জুডিশিয়ারি) সৃষ্টি করা হবে এবং সেটিকে দেওয়ানী আদালতের আওতায় আনা হবে। পোশাক শ্রমিক সংগঠন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম নেত্রী মোশরেফা মিশু বললেন, ‘শ্রম আদালত তুলে দিয়ে তা যদি দেওয়ানী আদালতের সাথে সংযুক্ত করা হয় তাহলে শ্রমিকদেরকে কোর্টের বারান্দাতেই পড়ে থাকতে হবে। বিচার তারা পাবে না। কারণ দেওয়ানী আদালতের মামলা দশ-পনের বছরেও নিষ্পত্তি হয় না।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা হায়দার আকবর খান রনো জানালেন যে, ‘গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে বাস্তবে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন হতে দিচ্ছেন না মালিকরা। অথচ তাঁরা বুঝতে চাচ্ছেন না যে তাদের শিল্পের স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে অনেক কিছুই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতো এবং অশান্তি হতো না।’
বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে পোশাক শিল্পে তাদের পরিস্থিতির কথা বললাম এজন্য যে, গার্মেন্টস কর্মীরা আমাদের কাছে সবচেয়ে দৃশ্যমান। এই শিল্পে ৩০ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ, অর্থাৎ ২৪ লক্ষই নারী শ্রমিক। আমাদের আশপাশ দিয়ে যখন এই নারী শ্রমিকরা যাওয়া-আসা করেন লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, তাদের বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভুগছেন। পোশাকে-আশাকেও এরা খুব দীনহীন। প্রায় সবার পায়ে থাকে রবারের চপ্পল, জুতো পরেনই না এঁরা।
বাংলাদেশে আরো বহু শ্রমিক আছেন। এঁদের সংখ্যা আড়াই কোটি থেকে তিন কোটির মধ্যে হবে বলে অনুমান করা হয়। এঁরা কাজ করছেন সড়ক ও জনপথ, নির্মাণ, বস্ত্র (সূতা তৈরি ও বুনন), ট্যানারি, জাহাজ ভাঙা, পোল্ট্রি ও চিংড়ি (প্রক্রিয়াজাতকরণ), চাতাল (ধান কল), ও কৃষি খাতে। এর সাথে সেবা খাত যোগ করলে তার মধ্যে আসবে দোকান-শ্রমিক এবং যানবাহন মেরামত কারখানার শ্রমিকগণ। নির্মাণ খাতের অন্তর্ভুক্ত করা যায় পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙার এবং ইট ভাটার শ্রমিকদের। এঁরা অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এঁরা মানবেতর পরিবেশে কাজ করেন। এদের মধ্যে বহু নারীশ্রমিক আছেন। পোশাক শিল্পের বাইরে মেয়েদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় নির্মাণ (মাটি কাটা ও ইট ভাঙার কাজে মূলত), চাতাল ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে।
এদের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, (১) বহু মানুষ শ্রমিক হিসাবে কিছু আয় করছেন, (২) এঁদের আয় খুব কম, যা দিয়ে দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়, (৩) এঁদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করেন এবং (৪) এঁদের বেশিরভাগই অসংগঠিত অর্থাৎ না আছে তাঁদের নির্ধারিত বেতন-ভাতা, না পান তাঁরা কোনো নিয়োগপত্র আর না তাঁরা কোনো ট্রেড ইউনিয়ন বা সমিতির সদস্য।
আরেকটি কথা, পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শ্রমিকদের যে রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল এখন তেমন দেখা যায় না।