কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে যে কাঁচপুর, মিরপুর ও গাজীপুরে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন, বিক্ষোভ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের খবর দেখলাম তাতে তো এই শ্রমিকদেরকে অতো দুর্বল মনে হয় না।’ তার উত্তরে শুনতে হবে: ‘ঐ শ্রমিককরা কি কোনো স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য? তারা যে আন্দোলনে নেমেছে তা কি বকেয়া বেতনভাতার জন্য নাকি পারিশ্রমিক বৃদ্ধির জন্য? আন্দোলন ছিল বকেয়া বেতনের জন্য এবং কয়েক বছর আগে সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম বেতন মাসিক ১৬৬২.৫০ (এক হাজার ছয়শত বাষট্টি টাকা পঞ্চাশ পয়সা) হারে পাবার জন্য। বকেয়া বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন তাদের পেট ও পিঠ একখানে হয়ে গেছে এবং ঘরভাড়া দিতে না পারায় যখন ঘর থেকে উৎখাত হবার জোগাড় হয়েছে কেবল তখন তারা রাস্তায় মিছিল বের করেছে।’
একই সাথে লক্ষণীয়, তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিলেই বা উত্তেজিত হয়ে কারখানায় ভাঙচুর করলেই শোনা যায় যে, এসবের পিছনে বিদেশী ষড়যন্ত্র আছে, গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করে বেকারত্ব সৃষ্টি করে এবং রপ্তানী আয় বন্ধ করে দিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। তাই শিল্পপুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করবে সরকার। একই সাথে প্রস্তাব আছে যে, শিল্প বিচার ব্যবস্থা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল জুডিশিয়ারি) সৃষ্টি করা হবে এবং সেটিকে দেওয়ানী আদালতের আওতায় আনা হবে। পোশাক শ্রমিক সংগঠন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম নেত্রী মোশরেফা মিশু বললেন, ‘শ্রম আদালত তুলে দিয়ে তা যদি দেওয়ানী আদালতের সাথে সংযুক্ত করা হয় তাহলে শ্রমিকদেরকে কোর্টের বারান্দাতেই পড়ে থাকতে হবে। বিচার তারা পাবে না। কারণ দেওয়ানী আদালতের মামলা দশ-পনের বছরেও নিষ্পত্তি হয় না।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা হায়দার আকবর খান রনো জানালেন যে, ‘গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে বাস্তবে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন হতে দিচ্ছেন না মালিকরা। অথচ তাঁরা বুঝতে চাচ্ছেন না যে তাদের শিল্পের স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে অনেক কিছুই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতো এবং অশান্তি হতো না।’
বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে পোশাক শিল্পে তাদের পরিস্থিতির কথা বললাম এজন্য যে, গার্মেন্টস কর্মীরা আমাদের কাছে সবচেয়ে দৃশ্যমান। এই শিল্পে ৩০ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ, অর্থাৎ ২৪ লক্ষই নারী শ্রমিক। আমাদের আশপাশ দিয়ে যখন এই নারী শ্রমিকরা যাওয়া-আসা করেন লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, তাদের বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভুগছেন। পোশাকে-আশাকেও এরা খুব দীনহীন। প্রায় সবার পায়ে থাকে রবারের চপ্পল, জুতো পরেনই না এঁরা।
বাংলাদেশে আরো বহু শ্রমিক আছেন। এঁদের সংখ্যা আড়াই কোটি থেকে তিন কোটির মধ্যে হবে বলে অনুমান করা হয়। এঁরা কাজ করছেন সড়ক ও জনপথ, নির্মাণ, বস্ত্র (সূতা তৈরি ও বুনন), ট্যানারি, জাহাজ ভাঙা, পোল্ট্রি ও চিংড়ি (প্রক্রিয়াজাতকরণ), চাতাল (ধান কল), ও কৃষি খাতে। এর সাথে সেবা খাত যোগ করলে তার মধ্যে আসবে দোকান-শ্রমিক এবং যানবাহন মেরামত কারখানার শ্রমিকগণ। নির্মাণ খাতের অন্তর্ভুক্ত করা যায় পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙার এবং ইট ভাটার শ্রমিকদের। এঁরা অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এঁরা মানবেতর পরিবেশে কাজ করেন। এদের মধ্যে বহু নারীশ্রমিক আছেন। পোশাক শিল্পের বাইরে মেয়েদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় নির্মাণ (মাটি কাটা ও ইট ভাঙার কাজে মূলত), চাতাল ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে।
এদের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, (১) বহু মানুষ শ্রমিক হিসাবে কিছু আয় করছেন, (২) এঁদের আয় খুব কম, যা দিয়ে দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়, (৩) এঁদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করেন এবং (৪) এঁদের বেশিরভাগই অসংগঠিত অর্থাৎ না আছে তাঁদের নির্ধারিত বেতন-ভাতা, না পান তাঁরা কোনো নিয়োগপত্র আর না তাঁরা কোনো ট্রেড ইউনিয়ন বা সমিতির সদস্য।
আরেকটি কথা, পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শ্রমিকদের যে রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল এখন তেমন দেখা যায় না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন