আতাউস সামাদ
সাংবাদিকতা সম্পর্কে ব্রিটেনের একটা বইতে পড়েছিলাম, গণমাধ্যমের দায়িত্বগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কর্তব্য হচ্ছে 'ধফাবত্ংধত্রধষ ত্ড়ষব' বা প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করা। এ ক্ষেত্রে অপর পক্ষ বলতে মূলত সরকারকে বোঝানো হচ্ছিল। কারণ একটা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে সাধারণত দেশের সরকার।
তবে দেশে দেশে সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, সরকার ছাড়াও গণমাধ্যমকে অন্য আরও কয়েকটি মহলের প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, যেমন রাজনীতিবিদদের, কারণ তারাই একটি দেশের প্রধান নীতিনির্ধারক, বড় ব্যবসায়ীদের বা ব্যবসায়িক করপোরেশনগুলোর, কারণ এরা মুনাফা কামাতে গিয়ে অনেক সময়ই জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়, আর ক্রাইম সিন্ডিকেট বা অপরাধী চক্রের, কারণ এরা অস্ত্র ও নিষ্ঠুরতার দ্বারা ত্রাস সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এও দেখা গেছে যে, অপরাধী চক্র বা ক্রাইম সিন্ডিকেটগুলো পুলিশ বাহিনী ও বিচার বিভাগের কিছু লোককে কিনে রাখে, যাতে তারা আইন ও আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে।
অন্যদিকে গণমাধ্যমগুলোর কাজের মূল ক্ষেত্রই হচ্ছে জনগণ এবং তাদের কাজ হচ্ছে জনস্বার্থে সত্য প্রকাশ করা। তাই শুধু বিনোদন পরিবেশনকারী মাধ্যমগুলো ছাড়া অন্য সব ধরনের পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও এবং অন-লাইন সাইটগুলোকে প্রায় রোজই কারও না কারও প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতেই হয়। এর কারণ খুব সোজা। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, অন্যায়কারী এবং জঘন্য অপরাধীদের বেআইনি কাজকর্মের তথ্য ফাঁস করা মানেই প্রকৃত সত্য প্রকাশ করা।
অবশ্য বাংলাদেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে কিন্তু গণমাধ্যমগুলো যে কার প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সেটা বাছবিচার করার অবকাশ তেমন একটা আর নেই, কারণ বর্তমান সরকারই জানিয়ে দিয়েছে যে সাংবাদিকরা তার প্রতিপক্ষ। ইদানীং সবাই দেখতে পারছেন ক্ষমতাসীনরা ঘনঘন প্রকাশ্য বার্তা পাঠাচ্ছে যে, গণমাধ্যম ভুল আর মিথ্যার বেসাতিতে নেমেছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং সাংবাদিকরা নিজ স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য মিথ্যা কথা বলছে। বর্তমান সরকারের দু-তিনজন মন্ত্রী প্রায়ই একথাগুলো বলছেন। ক্ষমতাসীন দলের পেশিশক্তিওয়ালা সদস্য ও সমর্থকরা যখনই প্রয়োজন মনে করছেন তখনই সাংবাদিকদের পিটিয়ে, কুপিয়ে গুরুতর আহত করে হাসপাতালে ঢুকতে বাধ্য করছেন আর পুলিশ তো সাংবাদিকদের অবাঞ্ছিত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। গত শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পলিটেকনিক ছাত্রীদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের ছবি তুলতে গেলে প্রথম আলো পত্রিকার তিনজন ফটো সাংবাদিক ও একজন প্রদায়ককে লাঠির ঘা, কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে ধরাশায়ী করে একদল পুলিশ। শহীদুল ইসলাম নামে যে পুলিশ কর্মকর্তা ওই প্রহার-অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন, তিনি হুকুমটা দেয়ার সময় লাঠি ও বুট-সজ্জিত কনস্টেবলদের বাড়তি উত্সাহ দিয়ে চিত্কার করতে থাকেন, ‘পেটা, শালাদের পেটা, কত সাংবাদিক পিটিয়েছি। সাংবাদিক পেটা। সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না।’ দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শহীদুল ইসলামের ওই প্রকাশ্য ঘোষণা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী দেশের সাংবাদিকদের সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করে তার সত্যিকার প্রতিফলন। আর পুলিশের এই দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে দারুণভাবে সহায়তা করেছে সরকারের আচরণ ও চণ্ডনীতি। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর দুই পুলিশ কর্মকর্তার বর্বর ও নৃশংস হামলার কথা। বিরোধী দলের একটা হরতাল চলার সময় সংসদ এলাকার মধ্যেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাদের বাহিনী নিয়ে জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় পুলিশের ভ্যান থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যায়। তারপর এই বিএনপি নেতাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং দিনকয়েকের ভেতর সুচিকিত্সার জন্য তাকে নিউইয়র্ক যেতে হয়। বিদেশ যাওয়ার সময় জামিন পেতে তাঁকে স্ট্রেচারে করে হাইকোর্টে নিতে হয়েছিল। এত কিছুর পরও জাতীয় সংসদের স্পিকার বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছেন বলে শুনিনি। আর অন্যদিকে ওই দুই বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ যেন তাদের কাপুরুষোচিত অভিযানের পুরস্কার। সাংবাদিক-পেটানো এসি শহীদুল ইসলামও পুরস্কৃত হবেন বলে আশা করতে পারেন। তাঁর পদোন্নতি না হয়ে যদি কোনো শাস্তি হয় তাহলে আমরা যারপরনাই বিস্মিত হবো। আমাদের জন্য সেটাই হবে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে ওই নৃশংস পুলিশ কর্মকর্তা ও তার সহযোগীদের যদি শাস্তি হয় তাহলে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে দ্বিধা করব না।
পুলিশ যে দুরাচরণ ও অত্যাচার করে এবং সেজন্য যে তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না তার আরেক জাজ্বল্যমান উদাহরণ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। দুই বছর আগে এক রাতে পুলিশ আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে শক্তি প্রয়োগ করে ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। গ্রেফতার অবস্থায়ও তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা দেয়। তারপর তাঁকে রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে গিয়ে গভীর রাতে কয়েকজন মুখোশধারীর হাতে তুলে দেয়া হয়। তারা তাঁকে বিবস্ত্র করে যে দৈহিক নির্যাতন চালায় তাতে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। বর্তমান সরকার আজ পর্যন্ত বলতে পারেনি যে, তারা এই বেআইনি কর্মের কোনো তদন্ত করেছে। অথচ তাঁকে গভীর রাতে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করায় আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দিয়ে রেখেছে এবং অভিযুক্তরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠিত চিকিত্সক ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের মহাসচিব ডা. জাহিদ হোসেনকে পুলিশ এক সন্ধ্যায় তাঁর চেম্বার থেকে গ্রেফতার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট—এমনকি এজাহারে যে অন্য একজনের নাম কেটে তাঁর নাম বসানো হয়েছিল তাও ছিল স্পষ্ট। তবুও পুলিশের হয়ে সরকার পক্ষের উকিল তাঁকে ৫৬ দিনের রিমান্ডে দেয়ার দাবি করেছিলেন। কিন্তু মামলার কাগজপত্রেই পুলিশের মিথ্যাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট সদয় হয়ে তাঁকে জামিন দেন। সরকার কি ওই মিথ্যা মামলা করার জন্য কোনো পুলিশের কাছ থেকে কৈফিয়ত নিয়েছে? নেবে বা কেন? ওই মামলা তো আসলে হয়েছিল সরকারের কোনো না কোনো কর্তাব্যক্তির ইশারায়। অতি সম্প্রতি পুলিশ ঢাকার ৭৪নং ওয়ার্ডের বিএনপি নেত্রী রেহানা আক্তার ডলিকে গ্রেফতার করে। তারপর দিন তাঁকে আদালতে নিয়ে গেলে দেখা যায় তার শরীরজুড়ে আঘাতের চিহ্ন। তিনি তখন হাঁটছিলেন অতিকষ্টে। একজন সুস্থ নারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর এ রকম গুরুতর আহত হলেন কীভাবে সরকার কি জানতে চেয়েছে এ পর্যন্ত?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনির হত্যাকাণ্ডের কথা এখনও দেশের ঘরে ঘরে উচ্চারিত হয়। তাদের খুন করার খবর আজও বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুলিশের তদন্তে ব্যর্থতার বড় উদাহরণ এটা। তবুও এই জোড়া খুন সম্পর্কে গণমাধ্যমের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মিডিয়ার লোকেরা সাগর-রুনির ফ্ল্যাটে ভিড় করায় আলামত নষ্ট হয়েছে। তিনি এও বলেছিলেন যে সরকারের পক্ষে সবার বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। একজন পুলিশ অফিসার পরে স্বীকার করেছেন যে, না, সব আলামত নষ্ট হয়নি, কিছু আলামত পাওয়া গেছে। আর হাইকোর্টের হুকুমে ওই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব র্যাবের হাতে যাওয়ার পর জানা গেল পুলিশ নিহত সাংবাদিক সাগর ও রুনির ভিসেরা পরীক্ষাই করেনি।
পুলিশ আরামে থাকতে পারে যারা সরকারে থাকেন তাদের খুশি রাখতে পারলেই। বিএনপি সরকারের আমলেও একই রকম ধারা দেখা গেছে। আর সেনাশাসক এরশাদ ও পরবর্তী অবৈধ মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সময়কার তো কথাই নেই। বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে, তার পূর্ববর্তী সেনাশাসক এরশাদ আমলের অনুসরণে পুলিশ বাহিনী জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢুকে সাংবাদিক পেটানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা আমরা আজও ভুলতে পারিনি। ভোলা যায় না, একটা অনর্থক মামলা দিয়ে জনকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান ও পত্রিকার তত্কালীন নির্বাহী সম্পাদক প্রয়াত বোরহান আহমদকে গ্রেফতার করার কথা। একটা নির্বাচিত সরকারের আমলে ওই ঘটনাগুলো ঘটেছিল বলে আমাদের দুঃখটা বেশি। আর বর্তমানের নির্বাচিত সরকারটি আমাদের দুঃখ বাড়িয়েই চলেছে। এই সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে ১৪ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। আর দেশের কোথাও না কোথায় সাংবাদিক নির্যাতনের খবর আসছে হরহামেশাই। আমাদের ভয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার যেন সাংবাদিকদের নির্যাতন করাটা একটা কর্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। ফলে পুলিশ হোক, র্যাব হোক, সংসদ সদস্য হোক অথবা হোক দু’পয়সার ক্যাডার—সবাই যেন সাংবাদিক নিপীড়নকে একটা উত্সবে আনন্দদায়ক বিনোদন হিসেবে ধরে নিয়েছেন। দেখা যাক, সাংবাদিকদের সমষ্টিগত প্রতিবাদ এ পরিস্থিতি একটুও বদলাতে পারে কি-না!
তবে দেশে দেশে সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, সরকার ছাড়াও গণমাধ্যমকে অন্য আরও কয়েকটি মহলের প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, যেমন রাজনীতিবিদদের, কারণ তারাই একটি দেশের প্রধান নীতিনির্ধারক, বড় ব্যবসায়ীদের বা ব্যবসায়িক করপোরেশনগুলোর, কারণ এরা মুনাফা কামাতে গিয়ে অনেক সময়ই জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়, আর ক্রাইম সিন্ডিকেট বা অপরাধী চক্রের, কারণ এরা অস্ত্র ও নিষ্ঠুরতার দ্বারা ত্রাস সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এও দেখা গেছে যে, অপরাধী চক্র বা ক্রাইম সিন্ডিকেটগুলো পুলিশ বাহিনী ও বিচার বিভাগের কিছু লোককে কিনে রাখে, যাতে তারা আইন ও আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে।
অন্যদিকে গণমাধ্যমগুলোর কাজের মূল ক্ষেত্রই হচ্ছে জনগণ এবং তাদের কাজ হচ্ছে জনস্বার্থে সত্য প্রকাশ করা। তাই শুধু বিনোদন পরিবেশনকারী মাধ্যমগুলো ছাড়া অন্য সব ধরনের পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও এবং অন-লাইন সাইটগুলোকে প্রায় রোজই কারও না কারও প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতেই হয়। এর কারণ খুব সোজা। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, অন্যায়কারী এবং জঘন্য অপরাধীদের বেআইনি কাজকর্মের তথ্য ফাঁস করা মানেই প্রকৃত সত্য প্রকাশ করা।
অবশ্য বাংলাদেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে কিন্তু গণমাধ্যমগুলো যে কার প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সেটা বাছবিচার করার অবকাশ তেমন একটা আর নেই, কারণ বর্তমান সরকারই জানিয়ে দিয়েছে যে সাংবাদিকরা তার প্রতিপক্ষ। ইদানীং সবাই দেখতে পারছেন ক্ষমতাসীনরা ঘনঘন প্রকাশ্য বার্তা পাঠাচ্ছে যে, গণমাধ্যম ভুল আর মিথ্যার বেসাতিতে নেমেছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং সাংবাদিকরা নিজ স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য মিথ্যা কথা বলছে। বর্তমান সরকারের দু-তিনজন মন্ত্রী প্রায়ই একথাগুলো বলছেন। ক্ষমতাসীন দলের পেশিশক্তিওয়ালা সদস্য ও সমর্থকরা যখনই প্রয়োজন মনে করছেন তখনই সাংবাদিকদের পিটিয়ে, কুপিয়ে গুরুতর আহত করে হাসপাতালে ঢুকতে বাধ্য করছেন আর পুলিশ তো সাংবাদিকদের অবাঞ্ছিত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। গত শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পলিটেকনিক ছাত্রীদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের ছবি তুলতে গেলে প্রথম আলো পত্রিকার তিনজন ফটো সাংবাদিক ও একজন প্রদায়ককে লাঠির ঘা, কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে ধরাশায়ী করে একদল পুলিশ। শহীদুল ইসলাম নামে যে পুলিশ কর্মকর্তা ওই প্রহার-অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন, তিনি হুকুমটা দেয়ার সময় লাঠি ও বুট-সজ্জিত কনস্টেবলদের বাড়তি উত্সাহ দিয়ে চিত্কার করতে থাকেন, ‘পেটা, শালাদের পেটা, কত সাংবাদিক পিটিয়েছি। সাংবাদিক পেটা। সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না।’ দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শহীদুল ইসলামের ওই প্রকাশ্য ঘোষণা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী দেশের সাংবাদিকদের সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করে তার সত্যিকার প্রতিফলন। আর পুলিশের এই দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে দারুণভাবে সহায়তা করেছে সরকারের আচরণ ও চণ্ডনীতি। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর দুই পুলিশ কর্মকর্তার বর্বর ও নৃশংস হামলার কথা। বিরোধী দলের একটা হরতাল চলার সময় সংসদ এলাকার মধ্যেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাদের বাহিনী নিয়ে জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় পুলিশের ভ্যান থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যায়। তারপর এই বিএনপি নেতাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং দিনকয়েকের ভেতর সুচিকিত্সার জন্য তাকে নিউইয়র্ক যেতে হয়। বিদেশ যাওয়ার সময় জামিন পেতে তাঁকে স্ট্রেচারে করে হাইকোর্টে নিতে হয়েছিল। এত কিছুর পরও জাতীয় সংসদের স্পিকার বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছেন বলে শুনিনি। আর অন্যদিকে ওই দুই বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ যেন তাদের কাপুরুষোচিত অভিযানের পুরস্কার। সাংবাদিক-পেটানো এসি শহীদুল ইসলামও পুরস্কৃত হবেন বলে আশা করতে পারেন। তাঁর পদোন্নতি না হয়ে যদি কোনো শাস্তি হয় তাহলে আমরা যারপরনাই বিস্মিত হবো। আমাদের জন্য সেটাই হবে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে ওই নৃশংস পুলিশ কর্মকর্তা ও তার সহযোগীদের যদি শাস্তি হয় তাহলে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে দ্বিধা করব না।
পুলিশ যে দুরাচরণ ও অত্যাচার করে এবং সেজন্য যে তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না তার আরেক জাজ্বল্যমান উদাহরণ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। দুই বছর আগে এক রাতে পুলিশ আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে শক্তি প্রয়োগ করে ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। গ্রেফতার অবস্থায়ও তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা দেয়। তারপর তাঁকে রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে গিয়ে গভীর রাতে কয়েকজন মুখোশধারীর হাতে তুলে দেয়া হয়। তারা তাঁকে বিবস্ত্র করে যে দৈহিক নির্যাতন চালায় তাতে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। বর্তমান সরকার আজ পর্যন্ত বলতে পারেনি যে, তারা এই বেআইনি কর্মের কোনো তদন্ত করেছে। অথচ তাঁকে গভীর রাতে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করায় আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দিয়ে রেখেছে এবং অভিযুক্তরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠিত চিকিত্সক ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের মহাসচিব ডা. জাহিদ হোসেনকে পুলিশ এক সন্ধ্যায় তাঁর চেম্বার থেকে গ্রেফতার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট—এমনকি এজাহারে যে অন্য একজনের নাম কেটে তাঁর নাম বসানো হয়েছিল তাও ছিল স্পষ্ট। তবুও পুলিশের হয়ে সরকার পক্ষের উকিল তাঁকে ৫৬ দিনের রিমান্ডে দেয়ার দাবি করেছিলেন। কিন্তু মামলার কাগজপত্রেই পুলিশের মিথ্যাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট সদয় হয়ে তাঁকে জামিন দেন। সরকার কি ওই মিথ্যা মামলা করার জন্য কোনো পুলিশের কাছ থেকে কৈফিয়ত নিয়েছে? নেবে বা কেন? ওই মামলা তো আসলে হয়েছিল সরকারের কোনো না কোনো কর্তাব্যক্তির ইশারায়। অতি সম্প্রতি পুলিশ ঢাকার ৭৪নং ওয়ার্ডের বিএনপি নেত্রী রেহানা আক্তার ডলিকে গ্রেফতার করে। তারপর দিন তাঁকে আদালতে নিয়ে গেলে দেখা যায় তার শরীরজুড়ে আঘাতের চিহ্ন। তিনি তখন হাঁটছিলেন অতিকষ্টে। একজন সুস্থ নারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর এ রকম গুরুতর আহত হলেন কীভাবে সরকার কি জানতে চেয়েছে এ পর্যন্ত?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনির হত্যাকাণ্ডের কথা এখনও দেশের ঘরে ঘরে উচ্চারিত হয়। তাদের খুন করার খবর আজও বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুলিশের তদন্তে ব্যর্থতার বড় উদাহরণ এটা। তবুও এই জোড়া খুন সম্পর্কে গণমাধ্যমের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মিডিয়ার লোকেরা সাগর-রুনির ফ্ল্যাটে ভিড় করায় আলামত নষ্ট হয়েছে। তিনি এও বলেছিলেন যে সরকারের পক্ষে সবার বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। একজন পুলিশ অফিসার পরে স্বীকার করেছেন যে, না, সব আলামত নষ্ট হয়নি, কিছু আলামত পাওয়া গেছে। আর হাইকোর্টের হুকুমে ওই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব র্যাবের হাতে যাওয়ার পর জানা গেল পুলিশ নিহত সাংবাদিক সাগর ও রুনির ভিসেরা পরীক্ষাই করেনি।
পুলিশ আরামে থাকতে পারে যারা সরকারে থাকেন তাদের খুশি রাখতে পারলেই। বিএনপি সরকারের আমলেও একই রকম ধারা দেখা গেছে। আর সেনাশাসক এরশাদ ও পরবর্তী অবৈধ মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সময়কার তো কথাই নেই। বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে, তার পূর্ববর্তী সেনাশাসক এরশাদ আমলের অনুসরণে পুলিশ বাহিনী জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢুকে সাংবাদিক পেটানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা আমরা আজও ভুলতে পারিনি। ভোলা যায় না, একটা অনর্থক মামলা দিয়ে জনকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান ও পত্রিকার তত্কালীন নির্বাহী সম্পাদক প্রয়াত বোরহান আহমদকে গ্রেফতার করার কথা। একটা নির্বাচিত সরকারের আমলে ওই ঘটনাগুলো ঘটেছিল বলে আমাদের দুঃখটা বেশি। আর বর্তমানের নির্বাচিত সরকারটি আমাদের দুঃখ বাড়িয়েই চলেছে। এই সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে ১৪ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। আর দেশের কোথাও না কোথায় সাংবাদিক নির্যাতনের খবর আসছে হরহামেশাই। আমাদের ভয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার যেন সাংবাদিকদের নির্যাতন করাটা একটা কর্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। ফলে পুলিশ হোক, র্যাব হোক, সংসদ সদস্য হোক অথবা হোক দু’পয়সার ক্যাডার—সবাই যেন সাংবাদিক নিপীড়নকে একটা উত্সবে আনন্দদায়ক বিনোদন হিসেবে ধরে নিয়েছেন। দেখা যাক, সাংবাদিকদের সমষ্টিগত প্রতিবাদ এ পরিস্থিতি একটুও বদলাতে পারে কি-না!