বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ২০১২

আওয়ামী লীগ সরকার কি এখনও সুবিবেচক হবে



আ তা উ স সা মা দ
জুন মাসের অর্ধেক পার হয়ে গেল কিন্তু ঢাকা শহরে আমরা বৃষ্টির জন্য কাতর হয়ে অপেক্ষা করছি। আবহাওয়া দফতরের আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বর্ষার শুরু। তার আগেই মে মাসের শেষভাগেও দু’চার দফা ভারী বর্ষণ হয় মাঝে মাঝে। এবার ঢাকায় সেই সময় বৃষ্টির একটু ভাব ছিল আর ছিল ঝড়ো হাওয়া। তবে জুন মাসের এ পর্যন্ত ছিল না বৃষ্টি, আছে দম বন্ধ করে আনা গরম। আর সেই সঙ্গে আছে হাওয়ায় ধুলার স্তর এবং এক ঘণ্টা পরপর বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হলেই সচল হয়ে ওঠা হাজার হাজার জেনারেটরের বাতাস ভারী করা বিশ্রী আওয়াজ। ঢাকা শহর ঘিরে যত ইটের ভাটা আছে, সেগুলোর ধোঁয়ার সঙ্গে মিশে ভাসতে থাকে সেখানকার ধুলা। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, প্রায় বছর খানেক ধরে রাজধানী ঢাকার আকাশে দিনরাত সকল সময়েই যে একটা ধূসর আবরণ দেখা যায়, তা মূলত এই ধোঁয়া ও ধুলার তৈরি। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাস্তাঘাটের ধুলা। প্রায় পুরো ঢাকা শহরজুড়ে এবার শুকনো মৌসুমে মহাসড়ক ও মাঝারি সড়ক, গভীর করে খোঁড়া হয়েছিল নানান রকম পাইপ বসাবার জন্য। সেসব গর্তের অনেকগুলো ফের মাটি দিয়ে ভরাট করলেও বেশ কিছুতে এখনও কাজ চলছে। তবে এসব সড়কই এখন মাটির কাঁচা রাস্তার রূপ ধারণ করেছে, কারণ এগুলো আবার পাকা করা সম্ভব হয়নি। যেখানে যেখানে ভরাট করা হয়েছে, সেখানে বালু আর মাটি এখনও জমাট বেঁধে বসেনি। কাজেই সেসব জায়গায় ঢালাই বা পিচ করার কাজ করা সম্ভব নয়। এসব কাটা-ভাঙা রাস্তা থেকেও খুব ধুলা হয়। খোঁড়াখুঁড়ি করা রাজধানীর এসব পথঘাটের অধিকাংশ পানি ও কাদায় ভরা বিপজ্জনক খানাখন্দে পরিণত হবে। তবু আমরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করছি যাতে আমাদের নিঃশ্বাস নেয়ার বাতাসটা নির্মল হয়, যাতে প্রাণ-ওষ্ঠাগত করে আনা গ্রীষ্মের উত্তাপ কিছুটা হলেও কমে আসে।
আমরা দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও তাপ এবং ধুলার প্রবাহ কমে আসার জন্য অপেক্ষা করছি। গত ১১ জুন, সোমবার, সরকার-বিরোধী ১৮ দলীয় জোটের বিশাল গণসমাবেশে বিএনপি’র চেয়ারপার্সন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মহাজোট তথা আওয়ামী লীগ সরকারকে আবারও আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়ার ব্যবস্থা নিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে ১৯৯৬ সাল থেকে চলে আসা এই ব্যবস্থা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তুলে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটভুক্ত সংসদ সদস্যরা। এই পঞ্চদশ সংশোধনীর প্রতিবাদ করে আসছে বিএনপি শুরু থেকেই। বিএনপি এবং ১৮ দলীয় জোট চেয়েছিল ক্ষমতাসীন দল ১০ জুনের মধ্যে পুরনো ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে তাদের সম্মতি ঘোষণা করুক। কিন্তু তা হয়নি। অবশ্য রমজান ও ঈদ সামনে রেখে ১৮ দলীয় জোট দেশে কোনো হাঙ্গামা বা বিশৃঙ্খলা চায় না বলে তাদের দাবি আদায়ের জন্য আপাতত কোনো ‘কঠোর কর্মসূচি’ দেয়া থেকে বিরত হয়েছে। তবে গত সোমবারের গণসমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার পদ্ধতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করলে ঈদুল ফিতরের পর থেকেই হরতাল ও অবরোধ এমনকি লাগাতার হরতাল বা অবরোধের মতো কর্মসূচি দিয়ে কঠিন আন্দোলন শুরু করবেন। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর দলের সংসদীয় কমিটির সভায় তাঁর দলের সংসদ সদস্যদের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য তৈরি হতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, সংশোধিত সংবিধানের ব্যবস্থা মোতাবেক ২৫ অক্টোবর ২০১৩ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে হবে এবং সেই নির্বাচন হতে হবে ২৫ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের মধ্যে। ওই নির্বাচন হবে এই সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার আগেই বলে জানিয়েছেন তিনি। অর্থাত্ বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনার শাসনের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, একথা পরিষ্কার করে দিয়েছেন তিনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে, কার অধীনে জাতীয় সংসদের নির্বাচন হবে সেই প্রশ্নে সরকারি জোট ও বিরোধী জোট একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করছে। এর ফলে রোজার ঈদের পর বাংলাদেশে একটা প্রচণ্ড উত্তেজনাকর ও দ্বন্দ্বমুখর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এরকম অবস্থা আমরা চাই না। তবে এটা এড়ানো কঠিন; কারণ, বর্তমান ব্যবস্থায় বাংলাদেশে সরকার গঠন করবে সেই দল বা জোট যারা জাতীয় সংসদের সংখ্যাগুরু আসনে নির্বাচিত হবে। সোজা কথা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন হচ্ছে ক্ষমতায় যাওয়ার নির্বাচন। আর এখনকার পরিস্থিতি হলো, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচনের সময় সর্বোচ্চ ‘সুবিধা’ পাওয়ার জন্য তখনও ক্ষমতায় থাকতে চায় আর বিএনপি ও তার বিরোধীদলীয় জোট সরকারি দলের কারচুপি ও পেশিশক্তির ভোট এবং সাজানো ফল ঘোষণার ফাঁদে পা দিয়ে ঠকতে চায় না বলে নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ বা কোনো দলকে সরকার চালাতে দিতে চায় না। তাই বিরোধী দলের দাবি—উঠিয়ে দেয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হবে। আমরা মনে করি, বর্তমান পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের জন্য সঠিক এবং সুবিবেচনার কাজ হবে অবিলম্বে সংবিধানে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃসংযোজন করা এবং এখনই দেশের মানুষকে জানিয়ে দেয়া যে, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় দেশের দায়িত্বে থাকবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমরা এমন কথাটি বলছি ভূমিতে বিরাজমান পরিস্থিতি (ড়হ ঃযব মত্ড়ঁহফ ংরঃঁধঃরড়হ) পর্যালোচনা করে। সংক্ষেপে সেই পরিস্থিতির বিবরণ দিই। এক. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার দাবি করছেন এবং তাঁর দলও বলে চলেছে যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা উঠিয়ে দেয়া হয়েছে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী। সেই এক ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বলা হয়েছিল, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা দেশের সংবিধানসম্মত নয়। তাই এটা তুলে দিতে হবে। তবে দেশের অবস্থা বিবেচনায় এই ব্যবস্থা আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বলবত রাখা যেতে পারে। কিন্তু কোনো বিচারপতিকে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করা যাবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর সংবিধান উপদেষ্টারা এই রায়ের শুধু প্রথম ভাগটিকে (অর্থাত্ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে অংশটি) আদালতের আদেশ বা হুকুম হিসেবে বর্ণনা করে সেটুকুই কার্যকর করেছেন। রায়ের বাকি অংশটুকু (আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে) সম্পর্কে তাঁদের দাবি হলো—এটা আদালতের পর্যবেক্ষণ মাত্র, আদেশ নয়। বিরোধী দলগুলো এবং প্রবীণ আইনজীবীরা অন্যদিকে দাবি করে আসছেন যে, পুরো রায়টিই আদেশ। এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক অতিসম্প্রতি বাংলাভিশন টেলিভিশনের সঙ্গে এক টেলিফোন সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ওই রায়ের দুটি অংশই আদেশ অর্থাত্ আগামী দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রেখে দেয়ার কথাটিও ‘আদালতের হুকুম’, ওটা পর্যবেক্ষণ বা সুপারিশ নয়। উল্লেখ্য, বিচারপতি খায়রুল হক ওই রায় দেয়ার সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন এবং তিনিই রায়টি ঘোষণা করেছিলেন। সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সর্বশেষ মন্তব্যের পর আর কারও পক্ষে এ দাবি করা চলে না যে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না রাখা সম্পর্কে তাঁদের দেয়া রায়ের কেবল প্রথম অংশ কার্যকর করতে হবে আর দ্বিতীয় অংশ গ্রাহ্য না করলেও চলে। এখানে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয়, তা হলো—বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন, তিনি এখন থেকে দুই মাস আগে পূর্ণাঙ্গ লিখিত রায়টি সুপ্রিমকোর্টে জমা দিয়েছেন। সেটি এতদিনেও প্রকাশিত না হওয়ায় তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। জনগণও সেই পূর্ণাঙ্গ রায়টি দেখতে আগ্রহী। আশা করি, এটি অচিরেই প্রকাশ করা হবে। তবে একথা এখনই বলা যায়, শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার তুলে দেয়ার জন্য তিনি ও ক্ষমতাসীনরা যে আইনি যুক্তি দেখিয়েছেন, তার ভিত্তি আর বিদ্যমান নেই। তাই পুরো রায় অনুযায়ী সংবিধান পুনরায় সংশোধন করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এখন তাঁদের জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। এক্ষেত্রে সংসদকে একটাই নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, সাবেক কোনো প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিমকোর্টের কোনো অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে যেহেতু নিয়োগ দেয়া যাবে না, সেক্ষেত্রে এই পদটি কীভাবে পূরণ করা হবে? জাতীয় সংসদই আলোচনা করে প্রক্রিয়াটি ঠিক করে দিতে পারে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে দ্বিতীয় বিবেচ্য হলো, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা নানান রকম সন্ত্রাসী ও সহিংস কর্মকাণ্ড করে চলেছে তারা এবার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই। তাদের সন্ত্রাসের সর্বশেষ উদাহরণ, সুপ্রিমকোর্টের জমিতে অবস্থিত সড়ক ভবনে গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের লোকেরা টেন্ডার দখল নিয়ে প্রকাশ্যে গোলাগুলি করে পাঁচজনকে ঘায়েল করে। ওই সময় পুলিশ বা আনসারের সশস্ত্র কোনো প্রহরীকে সেখানে দেখা যায়নি, যদিও বলিউডি ফিল্মের কায়দায় তারা হাজির হয় ওই দলীয় সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পরপরই। দ্বিতীয় উদাহরণ পুলিশকে নিয়ে। আওয়ামী দলীয়কৃত পুলিশ কোনো আইনকানুন মানে না। তাদের একদল ঝিনাইদহের এক গ্রামে আবদুল ওয়াহাব নামে এক ব্যবসায়ীর বাড়িতে রাতের আঁধারে হানা দিয়ে তাকে গুলি করে হত্যা করেছে। তৃতীয় উদাহরণ, গত সোমবার ঢাকায় বিরোধী ১৮-দলীয় জোটের গণসমাবেশে যাতে মানুষ যোগ না দিতে পারে, সেজন্য সরকারের নির্দেশে বাইরে থেকে ঢাকায় বাস ও লঞ্চ আসা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। তারা শ’য়ে শ’য়ে লোকজনকে গ্রেফতার করে। আর আওয়ামী ক্যাডাররা লাল জামা পরে লাঠিহাতে বুড়িগঙ্গায় নৌকার যাত্রীদের পিটিয়ে ঢাকায় আসা থেকে বিরত করার চেষ্টা করে। টঙ্গীতে এরকম ক্যাডাররা লগি দিয়ে ট্রেনযাত্রীদের পিটিয়ে ট্রেন থেকে নামিয়ে দেয়। অতএব একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, আওয়ামী লীগদলীয় সন্ত্রাসীরা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের গুণ্ডামার্কা বা অপরাধপ্রবণ মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচিত করার জন্য ভোটারদের ওপর তথা সাধারণ জনগণের ওপর এরকম সশস্ত্র ও সহিংস হামলা চালাবে। পুলিশ তাদের বাধা দেবে না; বরঞ্চ পুলিশ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন ও গ্রেফতার করবে, যেমন করছে বর্তমানে। ফলে নির্বাচনটি হবে একটি প্রহসন। এখনই বাংলাদেশে সুশাসন বলে কিছু নেই। তখন সুশাসনের কবর হয়ে যাবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দেশের ওপর থেকে সন্ত্রাসী-শাসন তুলে নিয়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিলে দেশের মানুষ খুশি হবে এবং এতে আখেরে আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও লাভবান হবে।
বাস্তবতা ভিন্ন। মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীনের অসাংবিধানিক সরকারের অধীনে ২০০৮-এর ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র ভরাডুবি হয়। আর আওয়ামী লীগ পায় বিস্ময়কর সাফল্য। ১/১১’র জরুরি আইনের অত্যাচারী অসাংবিধানিক সরকারের হাতে লাগাতার নির্যাতিত হওয়ার পর নির্বাচনে অতি সামান্য সংখ্যক আসন পাওয়ায় অনেকেই মনে করেছিলেন, বিএনপি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা এ নিয়ে হাসি-তামাশাও করেছেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত সাড়ে তিন বছরে বিএনপি তার অস্তিত্ব ভালোমতই টিকিয়ে রেখেছে। দলটি যে চাইলে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে পারবে সেটাও প্রমাণ করেছে। বিএনপি’র সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী প্রায় তিন মাস আগে তাঁর গাড়ির চালকসহ মাঝরাতে তাঁর বনানীর বাড়ির কাছের রাস্তা থেকে গুম হওয়ার পর দলটি পরপর পাঁচদিন হরতাল করেছে। হরতালের সময় একটি গাড়িতে অগ্নিসংযোগকে ছুতা করে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও প্রথম কাতারের অনেক নেতাকে সরকার গ্রেফতার করে আটক রেখেছে। তাঁদের দ্রুত বিচার আদালতে তোলা হচ্ছে। তাঁরা হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করার পর সরকার নানান আইনি জটিলতা সৃষ্টি করে তাঁদের আটক রেখেছে। আওয়ামী লীগ হয়তো ভেবেছিল, বিএনপি’র নেতাদের আটক রাখলে ও কর্মীদের ভয়ভীতি দেখালে ১৮-দলীয় জোটের ১১ জুনের গণসমাবেশ ব্যর্থ হবে। কিন্তু বিএনপি’র সমর্থকরা পুলিশের বেআইনি বাধা, গণগ্রেফতার ও আওয়ামী সমর্থক সন্ত্রাসীদের হাতে মারধর সহ্য করেও গণসমাবেশ খুব ভালোভাবেই সফল করেছে। এর আগে ১২ মার্চের ‘চলো চলো ঢাকা চলো’ কর্মসূচিও তারা একইভাবে সফল করেছিল সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। এসবের ফলে বেশিরভাগ মানুষ মনে করবেন, বিএনপি ও তার ১৮-দলীয় জোট আগামীতে কঠিন কর্মসূচি দিলে তা পালিত হবে। সরকার অনমনীয় থাকলে সে ক্ষেত্রে দেশে অশান্তি ও নিপীড়ন-নির্যাতন বাড়বে। জনগণ তা পছন্দ করবে না। তাই এক্ষেত্রেও সরকারের জন্য সুবিবেচনার কাজ হবে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পথ থেকে সরে আসা। আর তার উপায় হলো নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংশোধিত রূপে পুনঃপ্রবর্তন করা।

সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

সকলেই শুধায়, কেমন আছি আমরা



আ তা উ স সা মা দ
ঘরের বাইরে গেলেই কেউ না কেউ প্রশ্ন করেন, ‘দেশের অবস্থা কেমন? কী হচ্ছে দেশে?’ আমিও যাদের ওয়াকিবহাল বলে মনে করি তাদের কারও সঙ্গে দেখা হলে জিজ্ঞাসা করি, ‘আমরা কেমন অবস্থায় আছি? কোন দিকে যাচ্ছি?’ বাস্তবত এখন প্রায় সবাই অন্য সবাইকে এই একই প্রশ্ন করছেন। ‘প্রায় সবাই’ কথাটি ব্যবহার করলাম এ কারণে যে, যারা ক্ষমতায় আছেন, সরকার চালাচ্ছেন, সবাইকে হুকুম করে বেড়াতে পারেন এবং নানান সরকারি সুবিধা নিজেরা ভোগ করেন এবং নিজের খাতিরের লোকদের মধ্যে তা বিলি করেন—তারা ভালোই আছেন। তারা এও মনে করেন যে, দেশটাও তাদের মতোই ভালো আছে। তাই তারা সারাক্ষণই উচ্চকণ্ঠে বলে চলেছেন যে, দেশের মানুষ খুব ভালো আছে এবং তাদের অবস্থা দিন দিন আরও ভালো হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইদানীং বলেছেন, সরকারের যারা সমালোচক, যারা নিন্দুক, তারা নগরভিত্তিক কিছু সমস্যার নজির দেখিয়ে বলেন, দেশের অবস্থা ভালো নেই, কিন্তু তারা গ্রামে গিয়ে দেখে না যে সেখানকার মানুষ কত সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। ইদানীং রাজধানী ঢাকা ও দেশের আরও অনেক জায়গায় কখনও পুলিশ আর কখনও ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য ও অন্য নেতাদের নির্দেশে তাদের পেটোয়া বাহিনী সাংবাদিকদের ওপর অকথ্য শরীরিক নির্যাতন করার পর সমালোচনার ঝড় উঠলে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী মন্তব্য করেছেন যে, সাংবাদিকরা আগের চেয়ে ভালো আছেন। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় অনলাইন মতামত জরিপে বেশির ভাগ মতদানকারী (১৩৩৮ জনের মধ্যে ৫৮.৪৫%) তার মন্তব্য সঠিক বলে অভিহিত করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও বলেছেন যে, সাংবাদিকরা আগের চেয়ে এখন অনেক ভালো আছেন, তারা স্বাধীনভাবে লেখালেখি করছেন। তিনি এও বলেছেন যে, সাংবাদিকদের মধ্যে অনেকের পেটের ভাত হজম হয় না সরকারের সমালোচনা করে কিছু না লিখলে। তিনি এও অভিযোগ করেছেন যে, রোজই তিনি এমন কিছু খবর পড়েন যেগুলো ভুল অথবা যেগুলো খোঁজখবর নিয়ে লেখা হয়নি।
দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে প্রতিদিন যত খবর প্রকাশিত হয় বা সম্প্রচার মাধ্যমে প্রচার করা হয় তার প্রত্যেকটিই একেবারে নিখুঁত বা সঠিক তথ্যনির্ভর এমন দাবি আমিও করি না। কিন্তু এটুকু বলব যে, বেশিরভাগ খবরই সঠিক তথ্যনির্ভর হয়। মতামত যারা দেন তাদের কথা একটু ভিন্ন, কারণ তারা যা ভালো মনে করেন তাই বলেন। সংবিধানে সেই স্বাধীনতা দেয়া আছে। কিন্তু এক্ষেত্রেও একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, এসব ক্ষেত্রে সরকার-সমর্থকরা তাদের মন্তব্যে বিরোধী দলগুলোকে তুলোধুনো করেন, বিরোধীরা তাদের যতখানি সমালোচনা করেন তার সমানই অথবা কিছুটা বেশি। প্রধানমন্ত্রী বা তার মন্ত্রী ও উপদেষ্টারা এই সত্যটা এড়িয়ে যান। এক্ষেত্রে তাদের নজরে বস্তুনিষ্ঠতার সংজ্ঞা অক্লেশে পাল্টে যায়। আর আমাদের মুশকিলটা হচ্ছে ক্ষমতাসীনরা মেনে নিন বা না নিন সাংবাদিকদের মাথায়, মুখে, পিঠে লাঠির ঘায়ের দাগ ও পুলিশের সবুট লাথি খাবার অপমানে মনের ভেতর যে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তাতো বাস্তবিক, ওগুলো তো কাল্পনিক নয়।
এসব কথা লিখছি বলে কেউ সমালোচনা করতে পারেন যে, পুরনো গীতই গেয়ে চলেছি। আসলে তা নয়। পুরনো আঘাতের ব্যথাটার ওপর লাঠির বাড়ি নতুন করে পড়েছে বলে যন্ত্রণায় বেশি কাতর হয়ে পড়েছি আমরা। এই সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো চলমান বিভীষিকার সঙ্গে যোগ হয়েছে গুম আতঙ্ক। কোনো কোনো সাংবাদিক একটু সাহস করে সমাধান হয় নাই এমন রহস্য নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে নিজের বা স্বজনের ‘নিখোঁজ’ হয়ে যাওয়ার হুমকি পাচ্ছেন কর্কশ কণ্ঠধারীদের কাছ থেকে ফোনে। আর গতকালই আমার দেশ পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে, গোবিন্দগঞ্জে সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম জয় ১০ দিন ধরে নিখোঁজ আছেন। যেদিন থেকে তার খোঁজ নেই সেদিনই তিনি আগে একবার সন্ত্রাসীদের হামলায় পড়েছিলেন। দোয়া করতে থাকব তিনি যেন অচিরেই সুস্থদেহে ফেরত আসেন। তবে আমাদের এসব কান্নাকাটি যাতে কেউ অহেতুক মনে না করেন সেজন্য সবার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার-এর ২০১১-১২ সালের সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রিপোর্টের দিকে। এই রিপোর্টে ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান উপরের দিক থেকে ১২৯ নম্বরে। রিপোর্টে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে নেমে গেছে। উল্লেখ্য, গত ২০১০ সালে এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল উপর থেকে ১২৬ নম্বরে।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পর্কে দেশের ভেতরে যেহেতু দুটি ভিন্ন মতের অস্তিত্ব রয়েছে সে জন্য তৃতীয় একটি পক্ষের মতামত হিসেবে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার (RSF)-এর প্রতিবেদন উল্লেখ করলাম। অবশ্য আজকের এ লেখায় এই প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে দেশের ভেতরের অপর একটি অভিমত উল্লেখ করি, কারণ এটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এই অভিমতটি শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক এবিএম মূসার, যিনি এই বৃদ্ধ বয়সে এবং অসুস্থতার মাঝেও গণমাধ্যমে দেশের নানা সমস্যা সম্পর্কে তার বিশ্লেষণ ও মত দিয়ে চলেছেন। কিছুকাল আগে তিনি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, এখন লেখার ও বলার স্বাধীনতা আছে কিন্তু সংবাদ বা মন্তব্যটি প্রকাশিত হওয়ার পরদিন প্রতিবেদক বা ভাষ্যকারের যে কী হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।’
আর মাত্র দিন কয়েকের মধ্যে ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। দেশের অর্থনীতিতে কিছু সমস্যা থাকার কথা। অর্থনীতি কিছুটা চাপে পড়ার ব্যাপারটা তিনি এরই মধ্যে স্বীকার করেছেন, কিন্তু তবুও তিনি বলবেন, দেশ এগিয়ে চলেছে, বিশ্বমন্দার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম হলেও যতখানি হয়েছে তা প্রশংসনীয়। বিশ্বব্যাংকও ভালো-মন্দ মিলিয়ে কিছু বলেছে। তারা মন্তব্য করেছে, বিশ্বমন্দার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ঈর্ষণীয়, তবে তা এশীয় গড় প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম।
অর্থনীতির পরিসংখ্যানগত হিসাব-নিকাশ যাই হোক না কেন, আমজনতা দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করবে তারা কতটুকু আয় করতে পারছে আর জীবনযাত্রার জন্য তাদের কত ব্যয় করতে হচ্ছে। কথায় বলে, পেটে খেলে পিঠে সয়। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে, পেটে যথেষ্ট পড়ছে না। খরচ যত বেড়েছে আয় তত বাড়েনি। খরচের মধ্যে কেবল খাদ্যের দাম নয় সেই সঙ্গে চিকিত্সা, যাতায়াত, বস্ত্র, আশ্রয় ও শিক্ষার জন্য যা ব্যয় হয় সেটাও ধরতেই হয়। এই অতি সম্প্রতি খাদ্যসামগ্রীর দাম নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে আর বাড়িভাড়া, চিকিত্সা, যাতায়াত খরচ এবং শিক্ষার ব্যয়ও বেড়েছে। জীবনযাত্রা নিয়ে উত্কণ্ঠার সীমা নেই। কর্মসংস্থান কমে যাওয়ায় নতুন ও পুরাতন দুই শ্রেণীর বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। পরিস্থিতি আসলে আদৌ স্বস্তিদায়ক নয়। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গত নভেম্বরে প্রকাশিত UNDP’র মানব উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদনটি স্মরণ করা যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বের ২০১টি দেশের মধ্যে ওপর দিক থেকে ১৪৬তম, বলা যায়, তলানির দিকেই। ওই প্রতিবেদনে দিনে মার্কিন ১ ডলার ২৫ সেন্ট-এর চেয়ে কম আয় বাংলাদেশে এমন লোকের সংখ্যা ছিল দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৯.৬ ভাগ অর্থাত্ প্রায় অর্ধেক। চারদিকের অবস্থা দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, এই পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে গত কয়েক মাসে।
এদিকে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও দ্বন্দ্ব চলছে। জেল-জুলুম, জেলগেটে পুনরায় গ্রেফতার—এসব চলছেই। সঙ্গে চলছে সংলাপ-সম্ভাবনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা, যা এখনও মনে হয় নাটক বা প্রহসন। সামগ্রিকভাবে এই অবস্থায় আতঙ্কিত জনগণ তো স্বাভাবিকভাবেই একজন আরেকজনকে প্রশ্ন করবে, ‘কেমন আছি আমরা, কোথায় যাচ্ছি?’

সোমবার, ২৮ মে, ২০১২

সাংবাদিকরা মার খেতেই থাকবেন



আতাউস সামাদ
সাংবাদিকতা সম্পর্কে ব্রিটেনের একটা বইতে পড়েছিলাম, গণমাধ্যমের দায়িত্বগুলোর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটা কর্তব্য হচ্ছে 'ধফাবত্ংধত্রধষ ত্ড়ষব' বা প্রতিপক্ষের ভূমিকা পালন করা। এ ক্ষেত্রে অপর পক্ষ বলতে মূলত সরকারকে বোঝানো হচ্ছিল। কারণ একটা দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে সাধারণত দেশের সরকার।
তবে দেশে দেশে সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, সরকার ছাড়াও গণমাধ্যমকে অন্য আরও কয়েকটি মহলের প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়, যেমন রাজনীতিবিদদের, কারণ তারাই একটি দেশের প্রধান নীতিনির্ধারক, বড় ব্যবসায়ীদের বা ব্যবসায়িক করপোরেশনগুলোর, কারণ এরা মুনাফা কামাতে গিয়ে অনেক সময়ই জনস্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করে ও দুর্নীতির আশ্রয় নেয়, আর ক্রাইম সিন্ডিকেট বা অপরাধী চক্রের, কারণ এরা অস্ত্র ও নিষ্ঠুরতার দ্বারা ত্রাস সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। এও দেখা গেছে যে, অপরাধী চক্র বা ক্রাইম সিন্ডিকেটগুলো পুলিশ বাহিনী ও বিচার বিভাগের কিছু লোককে কিনে রাখে, যাতে তারা আইন ও আদালতের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারে।
অন্যদিকে গণমাধ্যমগুলোর কাজের মূল ক্ষেত্রই হচ্ছে জনগণ এবং তাদের কাজ হচ্ছে জনস্বার্থে সত্য প্রকাশ করা। তাই শুধু বিনোদন পরিবেশনকারী মাধ্যমগুলো ছাড়া অন্য সব ধরনের পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও এবং অন-লাইন সাইটগুলোকে প্রায় রোজই কারও না কারও প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়াতেই হয়। এর কারণ খুব সোজা। ক্ষমতার অপব্যবহারকারী, দুর্নীতিপরায়ণ, অন্যায়কারী এবং জঘন্য অপরাধীদের বেআইনি কাজকর্মের তথ্য ফাঁস করা মানেই প্রকৃত সত্য প্রকাশ করা।
অবশ্য বাংলাদেশে যে অবস্থা বিরাজ করছে তাতে কিন্তু গণমাধ্যমগুলো যে কার প্রতিপক্ষের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে সেটা বাছবিচার করার অবকাশ তেমন একটা আর নেই, কারণ বর্তমান সরকারই জানিয়ে দিয়েছে যে সাংবাদিকরা তার প্রতিপক্ষ। ইদানীং সবাই দেখতে পারছেন ক্ষমতাসীনরা ঘনঘন প্রকাশ্য বার্তা পাঠাচ্ছে যে, গণমাধ্যম ভুল আর মিথ্যার বেসাতিতে নেমেছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং সাংবাদিকরা নিজ স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য মিথ্যা কথা বলছে। বর্তমান সরকারের দু-তিনজন মন্ত্রী প্রায়ই একথাগুলো বলছেন। ক্ষমতাসীন দলের পেশিশক্তিওয়ালা সদস্য ও সমর্থকরা যখনই প্রয়োজন মনে করছেন তখনই সাংবাদিকদের পিটিয়ে, কুপিয়ে গুরুতর আহত করে হাসপাতালে ঢুকতে বাধ্য করছেন আর পুলিশ তো সাংবাদিকদের অবাঞ্ছিত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগেছে। গত শনিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পলিটেকনিক ছাত্রীদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের ছবি তুলতে গেলে প্রথম আলো পত্রিকার তিনজন ফটো সাংবাদিক ও একজন প্রদায়ককে লাঠির ঘা, কিল, ঘুষি ও লাথি মেরে ধরাশায়ী করে একদল পুলিশ। শহীদুল ইসলাম নামে যে পুলিশ কর্মকর্তা ওই প্রহার-অভিযান চালানোর নির্দেশ দেন, তিনি হুকুমটা দেয়ার সময় লাঠি ও বুট-সজ্জিত কনস্টেবলদের বাড়তি উত্সাহ দিয়ে চিত্কার করতে থাকেন, ‘পেটা, শালাদের পেটা, কত সাংবাদিক পিটিয়েছি। সাংবাদিক পেটা। সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না।’ দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার শহীদুল ইসলামের ওই প্রকাশ্য ঘোষণা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী দেশের সাংবাদিকদের সম্পর্কে যে মনোভাব পোষণ করে তার সত্যিকার প্রতিফলন। আর পুলিশের এই দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিতে দারুণভাবে সহায়তা করেছে সরকারের আচরণ ও চণ্ডনীতি। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বিরোধী দলের চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর দুই পুলিশ কর্মকর্তার বর্বর ও নৃশংস হামলার কথা। বিরোধী দলের একটা হরতাল চলার সময় সংসদ এলাকার মধ্যেই দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাদের বাহিনী নিয়ে জয়নুল আবদিন ফারুকের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় পুলিশের ভ্যান থেকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে যায়। তারপর এই বিএনপি নেতাকে জ্ঞানহীন অবস্থায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং দিনকয়েকের ভেতর সুচিকিত্সার জন্য তাকে নিউইয়র্ক যেতে হয়। বিদেশ যাওয়ার সময় জামিন পেতে তাঁকে স্ট্রেচারে করে হাইকোর্টে নিতে হয়েছিল। এত কিছুর পরও জাতীয় সংসদের স্পিকার বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছেন বলে শুনিনি। আর অন্যদিকে ওই দুই বিতর্কিত পুলিশ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ যেন তাদের কাপুরুষোচিত অভিযানের পুরস্কার। সাংবাদিক-পেটানো এসি শহীদুল ইসলামও পুরস্কৃত হবেন বলে আশা করতে পারেন। তাঁর পদোন্নতি না হয়ে যদি কোনো শাস্তি হয় তাহলে আমরা যারপরনাই বিস্মিত হবো। আমাদের জন্য সেটাই হবে স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। তবে ওই নৃশংস পুলিশ কর্মকর্তা ও তার সহযোগীদের যদি শাস্তি হয় তাহলে আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাতে দ্বিধা করব না।
পুলিশ যে দুরাচরণ ও অত্যাচার করে এবং সেজন্য যে তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না তার আরেক জাজ্বল্যমান উদাহরণ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান। দুই বছর আগে এক রাতে পুলিশ আমার দেশ পত্রিকা অফিস থেকে শক্তি প্রয়োগ করে ধরে নিয়ে যায় তাঁকে। গ্রেফতার অবস্থায়ও তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা দেয়। তারপর তাঁকে রিমান্ডে ক্যান্টনমেন্ট থানায় নিয়ে গিয়ে গভীর রাতে কয়েকজন মুখোশধারীর হাতে তুলে দেয়া হয়। তারা তাঁকে বিবস্ত্র করে যে দৈহিক নির্যাতন চালায় তাতে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। বর্তমান সরকার আজ পর্যন্ত বলতে পারেনি যে, তারা এই বেআইনি কর্মের কোনো তদন্ত করেছে। অথচ তাঁকে গভীর রাতে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করায় আমার দেশ পত্রিকার সাংবাদিক ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দিয়ে রেখেছে এবং অভিযুক্তরা নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিতে বাধ্য হচ্ছেন। প্রতিষ্ঠিত চিকিত্সক ও সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের মহাসচিব ডা. জাহিদ হোসেনকে পুলিশ এক সন্ধ্যায় তাঁর চেম্বার থেকে গ্রেফতার করেছিল। তাঁর বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছিল তা ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট—এমনকি এজাহারে যে অন্য একজনের নাম কেটে তাঁর নাম বসানো হয়েছিল তাও ছিল স্পষ্ট। তবুও পুলিশের হয়ে সরকার পক্ষের উকিল তাঁকে ৫৬ দিনের রিমান্ডে দেয়ার দাবি করেছিলেন। কিন্তু মামলার কাগজপত্রেই পুলিশের মিথ্যাচারের সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকায় ম্যাজিস্ট্রেট সদয় হয়ে তাঁকে জামিন দেন। সরকার কি ওই মিথ্যা মামলা করার জন্য কোনো পুলিশের কাছ থেকে কৈফিয়ত নিয়েছে? নেবে বা কেন? ওই মামলা তো আসলে হয়েছিল সরকারের কোনো না কোনো কর্তাব্যক্তির ইশারায়। অতি সম্প্রতি পুলিশ ঢাকার ৭৪নং ওয়ার্ডের বিএনপি নেত্রী রেহানা আক্তার ডলিকে গ্রেফতার করে। তারপর দিন তাঁকে আদালতে নিয়ে গেলে দেখা যায় তার শরীরজুড়ে আঘাতের চিহ্ন। তিনি তখন হাঁটছিলেন অতিকষ্টে। একজন সুস্থ নারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর এ রকম গুরুতর আহত হলেন কীভাবে সরকার কি জানতে চেয়েছে এ পর্যন্ত?
সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনির হত্যাকাণ্ডের কথা এখনও দেশের ঘরে ঘরে উচ্চারিত হয়। তাদের খুন করার খবর আজও বহির্বিশ্বের গণমাধ্যমে উল্লেখ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুলিশের তদন্তে ব্যর্থতার বড় উদাহরণ এটা। তবুও এই জোড়া খুন সম্পর্কে গণমাধ্যমের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন। প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মিডিয়ার লোকেরা সাগর-রুনির ফ্ল্যাটে ভিড় করায় আলামত নষ্ট হয়েছে। তিনি এও বলেছিলেন যে সরকারের পক্ষে সবার বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। একজন পুলিশ অফিসার পরে স্বীকার করেছেন যে, না, সব আলামত নষ্ট হয়নি, কিছু আলামত পাওয়া গেছে। আর হাইকোর্টের হুকুমে ওই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব র্যাবের হাতে যাওয়ার পর জানা গেল পুলিশ নিহত সাংবাদিক সাগর ও রুনির ভিসেরা পরীক্ষাই করেনি।
পুলিশ আরামে থাকতে পারে যারা সরকারে থাকেন তাদের খুশি রাখতে পারলেই। বিএনপি সরকারের আমলেও একই রকম ধারা দেখা গেছে। আর সেনাশাসক এরশাদ ও পরবর্তী অবৈধ মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকারের সময়কার তো কথাই নেই। বেগম জিয়ার প্রথম শাসনামলে, তার পূর্ববর্তী সেনাশাসক এরশাদ আমলের অনুসরণে পুলিশ বাহিনী জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢুকে সাংবাদিক পেটানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা আমরা আজও ভুলতে পারিনি। ভোলা যায় না, একটা অনর্থক মামলা দিয়ে জনকণ্ঠ পত্রিকার উপদেষ্টা সম্পাদক প্রবীণ সাংবাদিক তোয়াব খান ও পত্রিকার তত্কালীন নির্বাহী সম্পাদক প্রয়াত বোরহান আহমদকে গ্রেফতার করার কথা। একটা নির্বাচিত সরকারের আমলে ওই ঘটনাগুলো ঘটেছিল বলে আমাদের দুঃখটা বেশি। আর বর্তমানের নির্বাচিত সরকারটি আমাদের দুঃখ বাড়িয়েই চলেছে। এই সরকারের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে বাংলাদেশে ১৪ জন সাংবাদিক খুন হয়েছেন। আর দেশের কোথাও না কোথায় সাংবাদিক নির্যাতনের খবর আসছে হরহামেশাই। আমাদের ভয় হচ্ছে, বর্তমান সরকার যেন সাংবাদিকদের নির্যাতন করাটা একটা কর্তব্য হিসেবে ধরে নিয়েছে। ফলে পুলিশ হোক, র্যাব হোক, সংসদ সদস্য হোক অথবা হোক দু’পয়সার ক্যাডার—সবাই যেন সাংবাদিক নিপীড়নকে একটা উত্সবে আনন্দদায়ক বিনোদন হিসেবে ধরে নিয়েছেন। দেখা যাক, সাংবাদিকদের সমষ্টিগত প্রতিবাদ এ পরিস্থিতি একটুও বদলাতে পারে কি-না!

সোমবার, ১৪ মে, ২০১২

অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি



আতাউস সামাদ
গত পরশু (রোববার) বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের সমাবেশ ও মিছিল শেষ পর্যন্ত রূপ নিয়েছিল বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষে। গুম হয়ে যাওয়া বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী ও তার গাড়ির ড্রাইভার আনসার আলীকে জীবিত ও সুস্থ অবস্থায় তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে এবং ওই দাবিতে এর আগে যে হরতাল হয়েছে তখন ঢাকায় গাড়ি পোড়ানো ও সরকারের সচিবালয়ে ককটেল বিস্ফোরণের জন্য দায়ী করে জোটের নেতাদের বিরুদ্ধে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে সেগুলো তুলে নেয়ার, ধর-পাকড় বন্ধ করার ও গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করতে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির লক্ষ্যে ওই সমাবেশ ও মিছিল কর্মসূচি নিয়েছিলেন জোট নেতারা। আওয়ামী লীগ সরকার সম্ভবত অনুমান করতে পেরেছিল যে, চট্টগ্রামে বিরোধী জোটের প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অনেক মানুষ যোগ দেবেন। আর তাদের প্রতিবাদ কর্মসূচি ভণ্ডুল করার জন্য সরকার যুত্সই পুলিশি বন্দোবস্ত নিয়ে রেখেছিল। অতঃপর দেখা গেল পুলিশ বাদানুবাদের অজুহাতে একটি মিছিলকে বাধা দিল। পুলিশের বাধা ভাঙার জন্য অন্য প্রতিবাদকারীরা এগিয়ে এলেন। পুলিশ তখন চণ্ড মূর্তিতে আত্মপ্রকাশ করল। শুরু হলো লাঠিপেটা ও টিয়ার গ্যাস। এবার বিক্ষোভকারীরাও রুদ্র রূপ ধারণ করলেন। পুলিশের লাঠি, টিয়ার গ্যাস শেল, রাবার বুলেট ও ফাঁকা গুলি বনাম বিক্ষোভকারীদের ইট-পাটকেল। আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে এ লড়াই। চট্টগ্রাম শহরের প্রায় অর্ধেক অংশ রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আর তা হয় কারণ, পুলিশ-রাজনৈতিক কর্মী সংঘর্ষের একপর্যায়ে সাধারণ জনগণও বিক্ষোভে যোগ দেন।
গত পরশু সন্ধ্যায় ও রাতে টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে সারাদেশের মানুষ চট্টগ্রামের বিক্ষোভ আর পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ছবি দেখেছেন। তারা দেখেছেন পুলিশ তাদের নানারকম বন্দুকের ট্রিগার টিপেই চলেছে। অন্যদিকে বিক্ষোভকারীরা শিলাবৃষ্টির মতো পুলিশকে লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়ছেন। একসময় কিছু বিক্ষোভকারী এমনভাবেই একটি সাদা রঙের মোটরগাড়ি উল্টে দিলেন যে মনে হচ্ছিল একটা ঝড় বুঝি গাড়িটাকে উড়িয়ে নিতে যাচ্ছিল। মুহূর্ত পরেই গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। এসব উত্তেজনাপূর্ণ, সংঘাতময় ও বিপজ্জনক ঘটনার কথা পুনরুল্লেখ করলাম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে। মনে হচ্ছে, সারাদেশের মানুষ সরকারকে যে বিপজ্জনক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে মানা করে আসছিলেন এখন আমরা সেই বিপদের মধ্যেই পড়ে গেছি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে শ্রমিক অসন্তোষ।
সরকার ও বিরোধী দলকে সব শান্তিপ্রিয় ও চিন্তাশীল লোক অনুরোধ করেছিলেন সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক বিরোধের মীমাংসা করতে। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। কোনো শক্তিশালী রাজনৈতিক দল যদি মাসের পর মাস রাজপথের সংগ্রাম করে যায় তাহলে একপর্যায়ে যে তাদের প্রতিপক্ষ সরকার তাতে দুর্বল হয়ে আন্দোলনকারীদের দাবি মানতে বাধ্য হয় সে কথা এদেশকে ও বিএনপি-কে বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগই শিখিয়েছে। এবার বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো সেই শিক্ষাকেই কাজে লাগাচ্ছে। কিন্তু এখানেও কথা আছে, বিরোধী দলগুলো নিজে থেকে আন্দোলন ও সংঘর্ষের পথ বেছে নেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের মহাজোট সরকার তাদের বাধ্য করেছে রাজপথে নামতে। হঠাত্ করেই এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলতে গেলে একক সিদ্ধান্তে জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার ব্যবস্থা তুলে দিয়ে এবং বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ও অন্য বিরুদ্ধমতাবলম্বীদের ওপর নিরবচ্ছিন্নভাবে শারীরিক হামলা, ফৌজদারি মামলা (যার বেশিরভাগই মিথ্যা), গ্রেফতার ও রিমান্ডে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে এই সরকার, তাদের বেসরকারি পেটোয়া বাহিনী ও তাদের নির্দেশে পুলিশের বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত (লিখিত বা অলিখিত) আইন লঙ্ঘনকারী সদস্যদের নারকীয় জুলুমবিরোধী দলগুলোকে বাধ্য করেছে রাজপথে নেমে প্রতিবাদমুখর হতে। একইসঙ্গে সরকার পরিচালনাকারীদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি, দেশজুড়ে সরকারি জোটের লোকজন লুটপাটের মহোত্সবে নেমে পড়া এবং তাদের শঠতা, প্রতারণা ও দস্যুতার জন্য একদিকে নিত্যপণ্যের মূল্য লাগামহীনভাবে বেড়ে যাওয়া আর অন্যদিকে প্রাণ ও মানসম্মান দুই-ই যে কোনো সময় চলে যাওয়ার দুশ্চিন্তায় যন্ত্রণাকাতর হয়ে জনগণও এখন সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলনকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। গত পরশু চট্টগ্রামের ঘটনাবলী সেই রকম বার্তাই বয়ে আনছে।
অন্যদিকে সরকার শান্তিপূর্ণ সংলাপ এবং সেরকম আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করার জন্য কাজ না করে পুলিশ, র্যাব, গুলি, লাঠি, গুম ও গ্রেফতারের মাধ্যমে ‘গণতন্ত্র বিজয়’ করার জন্য ‘বদ্ধপরিকর’ হয়ে রয়েছে। কাজেই আপাতত বিরোধী রাজনীতিবিদ, তাদের সমর্থক ও সাধারণ মানুষ বর্তমান নিপীড়ক ও দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। এরা যে স্বৈরতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারিতা করছেন তা ফ্যাসিস্ট কায়দায়। তবে ফ্যাসিজম ও ডিক্টেটরশিপ এক ধরনের জনযুদ্ধের প্রেক্ষিত রচনা করে। কেউ যেন আমার এ সতর্কবাণীকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার উস্কানি’ বলে ধরে নেবেন না। নানা দেশে চলমান বা নিকটঅতীতের অশান্তির ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই আমার কথার প্রমাণ পেয়ে যাবেন।
দু’দিন আগে মতামত জরিপকারী মার্কিনি প্রতিষ্ঠান গ্যালাপ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের প্রতি তাদের নিজ নিজ রাষ্ট্রের জনগণের কতখানি সমর্থন রয়েছে তার একটি জরিপ-ফলাফল প্রকাশ করেছে। গ্যালাপ প্রতিষ্ঠানটি বেশ পুরনো এবং মার্কিনি মিডিয়ার কল্যাণে বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এই গ্যালাপের এশিয়া বিষয়ক জরিপ বলছে যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ পরিচালনার প্রতি তার দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষের আস্থা রয়েছে। অনাস্থা রয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশের। এই গ্যালাপ-জরিপ দেখে শেখ হাসিনা মনে করতে পারেন যে, তিনি, তার সরকার ও তার দল গত তিন বছর ধরে যা যা করেছেন তার সবই খুব ভালো। তারা বলতে পারেন যে, তাদের কোনো ব্যর্থতা নেই। তারা এই সিদ্ধান্তও নিতে পারেন যে, যারা তাদের সমালোচনা করে বা বিরোধিতা করে তারা সবাই ষড়যন্ত্রকারী, মিথ্যাবাদী এবং সেজন্য পিটিয়ে তাদের হাড়গোড় ভেঙে মেরে নির্জন রাস্তার পাশে বা খানাখন্দে ফেলে রাখাই হচ্ছে উপযুক্ত শাস্তি। আর তাদের কাউকে জেলে পাঠানো হবে নেহাতই দয়া প্রদর্শন। অর্থাত্ এখন বিরোধীদের ওপর সরকারি নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়াটাই হবে ‘যুক্তিসঙ্গত’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকারের কাছে আমাদের বিনীত নিবেদন যে, গ্যালাপের একেবারে বিপরীত ফলাফল দেখা যাচ্ছে এমন মতামত জরিপও আছে। সেগুলোও মনে রাখবেন। যেমন ঢাকার ইংরেজি পত্রিকা ডেইলি স্টার এই বছরের (২০১২) ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের তিন বছরপূর্তি উপলক্ষে একটা মতামত জরিপ প্রকাশ করেছিল। তাতে একটা প্রশ্ন ছিল, আপনি কি মনে করেন দেশ সঠিক পথে চলছে, না ভুল পথে যাচ্ছে? এর উত্তরে ৪৪ শতাংশ অভিমতদাতা বলেছিলেন, দেশ ভুল পথে চলেছে। আর দেশ সঠিক পথে চলেছে বলেছিলেন ৪১ শতাংশ। দেশে ‘কোনো পরিবর্তন নেই’ বলেছিলেন ১৪ শতাংশ মতদাতা। অর্থাত্ বেশিরভাগ উত্তরদাতা জানিয়েছিলেন, তারা বর্তমান সরকারের দেশ পরিচালনার ফলাফল দেখে অসন্তুষ্ট। ডেইলি স্টার পত্রিকার ওই জরিপে আরেকটা প্রশ্ন ছিল, আগামীকাল যদি দেশে নির্বাচন হয় তাহলে আপনি কোন দলকে ভোট দেবেন? এর উত্তরে ৪০ শতাংশ জানিয়েছিলেন তারা আওয়ামী লীগকে (শেখ হাসিনার দল) ভোট দেবেন, ৩৭ শতাংশ বলেছিলেন বিএনপিকে এবং ৬ শতাংশ দেবেন জাতীয় পার্টিকে। এই দুই প্রশ্নের উত্তরে দেখা যাচ্ছে কোনোক্রমেই ৭৭ শতাংশ অভিমতদানকারী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নয়।
ওই একই সময়ে ঢাকার প্রথম আলো পত্রিকাও আলাদা একটি মতামত জরিপ প্রকাশ করে। তাতে দেখা গিয়েছিল শতকরা ৫২ জন মতদানকারী মহাজোট সরকারের কাজকর্মে অসন্তুষ্ট। আর দলীয় ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষে মত দিয়েছিলেন ৩৮ শতাংশ এবং বিরোধী দল বিএনপির পক্ষে ছিলেন শতকরা ৪৩ জন। ঘরের যোগীদের পায়ে না ঠেললেও পারবেন বর্তমান সরকার। বরং তাদের সংগৃহীত মতামতকে গুরুত্ব দিলেই ভালো হবে, কারণ, গ্যালাপ প্রতিষ্ঠানের নিজ দেশের সরকার এখন আওয়ামী লীগের কাজকর্মে মেলা ঘাটতি দেখতে পাচ্ছে। আবার দেশেও বর্তমান সরকারের আন্তরিক সমর্থক পত্রিকা সমকাল গত জানুয়ারিতে সরকারের তিন বছর নিয়ে যে মতামত জরিপ প্রকাশ করেছিল তাতেও সরকারের কাজকর্মে অসন্তুষ্টদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখা গিয়েছিল। এখানে মনে রাখা ভালো হবে যে, গ্যালাপের জরিপ চলে গত বছর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত। ডেইলি স্টার, প্রথম আলো ও সমকাল তাদের জরিপগুলো করে গত ডিসেম্বরের দিকে। তাছাড়া, আট মাস ধরে গ্যালাপ মতামত সংগ্রহ করে মাত্র ১০০০ জনের। প্রথম আলো, স্টার ও সমকাল মতামত নেয় অনেক বেশি মানুষের। আর আট মাস ধরে কোনো সরকার বা কোনো সরকারের প্রধানন্ত্রীর প্রতি তার দেশের জনগণের সমর্থন একই রকম থাকবে, এই তত্ত্বটির ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে গ্যালাপের কাছে। একটি বিষয়ে এতদিন ধরে এত কম সংখ্যক মানুষের মত নিয়ে কোনো জরিপ আমি এই প্রথম দেখলাম। তবে আমরা বোকারা আর কতটুকুই-বা জানি!

বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১২

যৌথবিবৃতি: বিদেশ যেতে বাধা দান করে দমনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

আতাউস সামাদ ও ফরহাদ মজহার
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারী রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিনকে দিয়ে জরুরী আইনের শাসন জারী করিয়ে যে অনির্বাচিত সরকার অসাংবিধানিকভাবে পরবর্তী দুই বছর দেশ শাসন করে তারা জনগণের মৌলিক অধিকার,মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অধিকার লুপ্ত করেছিলেন। এই শাসকরা একদিকে নানান পন্থায় দেশজুড়ে ত্রাসের সঞ্চার করেন এবং অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্রহনন ও তাঁদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। তত্ত্বাবধায়ক নামধারী ঐ অসাংবিধানিক শাসকদের উদ্দেশ্য ছিল যে ভয় পেয়ে জনগণ যেন প্রতিবাদী না হয়ে ওঠেন এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরাও যেন তাদের নেতৃত্ব দিতে না পারেন। আমরা সেই অন্ধকার দিনগুলি পিছনে ফেলে এসেছি।
কিন্তু অতীব দুঃখের সঙ্গে আমরা দেখতে পাচ্ছি, তথাকথিত ১/১১ সরকারকে বিদায় দিয়ে দেশের যে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটিও ঐ অসাংবিধানিক সরকারের কিছু অবৈধ কর্মকান্ডের ধারা উৎসাহের সাথে অব্যাহত রেখেছে যেন এসব তাঁদের গৌরবময় উত্তরাধিকার। এর মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার, জামিন পেতে বাধা দেওয়া ও সেজন্য আদালতকে মিথ্যা তথ্য দান, রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচার, সভা-সম্মেলন বাধা দিয়ে পণ্ড করা এবং মুক্তভাবে চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা। বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধবাদীদের বিদেশ যেতে বাধা দান। এই শেষোক্ত বিষয়টি এখন বাংলাদেশিদের জন্য, অর্থাৎ এদেশের নাগরিকদের জন্য মারাত্মক হয়রানি ও গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের কারণে পরিণত হয়েছে। এর একটা জঘন্য দিক হচ্ছে সরকার ক্ষমতার অবৈধ ব্যবহার করে নিরাপরাধ নাগরিকদেরকে কোন কারণ না দেখিয়ে বিমান বন্দর বা অন্য বহির্গমন পথ থেকে ফিরিয়ে দিয়ে তাদেরকে মানসিক, শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং ‘বিপজ্জনক’ হিসাবে চিত্রিত করে তাকে সামাজিকভাবে হেয় করছে। একই সাথে সরকারে অবস্থানকারী কিছু ব্যক্তি পর্দার অন্তরালে অবস্থান করে এভাবে সংবিধান লংঘন করে নিজেদেরকে দিনে দিনে অধিকতর বলদর্পী করে তুলছেন এবং দেশে গণতন্ত্র, নিয়মতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি হুমকি হয়ে উঠছেন। আমরা সরকারকে বিনয়ের সাথে বলতে চাই যে, এসব কুকাণ্ড এখনই বন্ধ করা উচিৎ।
আমরা জনগণের সুবিধার জন্য এখানে সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি: “জনস্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, ইহার যে কোন স্থানে বসবাস ও বসতিস্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে”। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের (Universal Declaration of Human Rights) অনুচ্ছেদ ১৩(২)বলছে, “প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজের দেশসহ যে কোন দেশ ত্যাগ করার এবং নিজের দেশে প্রত্যাবর্তন করবার অধিকার রয়েছে’। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদের (International Covenant on Civil and Political Rights) ১২(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী “প্রতিটি ব্যক্তি নিজের দেশসহ যে কোন দেশ ত্যাগ করবার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবে” এবং ১২(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “নিজের দেশে প্রত্যাবর্তন করবার ক্ষেত্রে কাউকেই খামখেয়ালী কায়দায় বঞ্চিত করা যাবে না”। আমরা সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ এই সকল আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং এই সকল অনুচ্ছেদের নির্দেশ অতএব মানতে বাধ্য।
গত তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বিদেশ থেকে দেশে ফিরতে বাধা দিয়েছিল তখন আমরা সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সংবিধান ও এই সব সনদের ভিত্তিতে বাংলাদেশ থেকেই এই আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সনদগুলো আমাদেরকে শুধু দেশের ভিতরে চলাফেরা করার স্বাধীনতাই দেয় নাই, বিদেশে যাবার এবং ফিরে আসার অধিকারও সুস্পষ্টভাবে দিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ্য যে ‘জনস্বার্থে’ সরকার নিয়ন্ত্রণের যে ক্ষমতা পেতে পারে তা অবশ্যই ‘আইনের দ্বারা আরোপিত’ ও ‘যুক্তিসঙ্গত’ হতে হবে। সেই আইন তো বলবৎ আছেই। লক্ষণীয় যে কোন নাগরিকের বিদেশ যাবার প্রস্তুতি থেকেই সরকার তার ওপর আইনসঙ্গত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে কারণ,দেশের বাইরে কোথাও যেতে হলে আমাদেরকে প্রথমেই সরকারের কাছ থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হয়। কাউকে পাসপোর্ট দেবার আগে সংশ্লিষ্ট দপ্তর তার সম্পর্কে পুলিশি তদন্ত করিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে নেয় যে তাকে বিদেশ ভ্রমণের ছাড়পত্রটি দেয়া যাবে। আর পাসপোর্ট পেলেই বিদেশ যাওয়া যায় না। বিদেশগামী বাংলাদেশি যে দেশে বা দেশগুলিতে যাবেন তাঁকে সেসব দেশে ঢোকার ও নির্দ্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করার জন্য ঐ দেশের দূতাবাস থেকে ভিসা সংগ্রহ করতে হয়। তারপর বিমান বা অন্য উপযুক্ত বাহনের টিকিট সংগ্রহ করতে হয়। তাঁকে বহনকারী প্রতিষ্ঠান, যথা, কোন এয়ার লাইন, বহির্গমন বন্দরে ভ্রমণ সংক্রান্ত তাঁর সকল দলিলপত্র পরীক্ষা করে তবেই বিমান বা প্রয়োজনীয় বাহনে উঠতে দেয়। এক্ষেত্রে বিমান বন্দরে বা অন্য কোন বহির্গমন বন্দরে আমাদের ইমিগ্রেশন বিভাগের জন্য ইতিমধ্যেই পরীক্ষা হয়ে যাওয়া দলিলপত্র আবার পরখ করে দেখা,তাদের প্রয়োজনীয় কাগজটি (ইমিগ্রেশন ফর্ম) সংগ্রহ করা এবং বিদেশগামী ব্যক্তির পাসপোর্টে সিল দেয়া ছাড়া আর কোন কাজ নেই। কিন্তু তারাই যখন বৈধ পাসপোর্ট, ভিসা ও টিকেটধারী কোন ব্যক্তিকে কোন কারণ না দেখিয়ে হুকুম করেন যে তাঁকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে তখন তাঁরা এক আঘাতে সেই ব্যক্তিটির নানান রকম ক্ষতি সাধন করেন যা করার অধিকার আইনত তাঁদের নেই। আর তাঁরা যখন বলেন যে, ওপরের নির্দেশে তাঁদেরকে দেশের বাইরে যেতে দেওয়া হবে না কিন্তু সেই নির্দেশদাতার পরিচয় দিতে পারেন না তখন তাঁরা বা সেই অতি ক্ষমতাশালী ওপরওয়ালারা বাংলাদেশকে একটি আইন অমান্যকারী অসভ্য তথা বর্বর দেশ হিসাবে বিশ্বের কাছে প্রতিভাত করেন। দুঃখের বিষয় হলো যে নাগরিকের সংবিধানপ্রদত্ত অধিকারের ওপর সরকারের এরকম নিপীড়নমূলক হস্তক্ষেপ উচ্চ আদালতে বারবার অবৈধ ঘোষিত হবার পরও বর্তমান সরকার এই যন্ত্রণাদায়ক, একান্ত গর্হিত ও খুবই নিন্দনীয় কার্যক্রমটি চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
ইতোমধ্যে, আমরা আবার বিস্মিত হয়ে দেখলাম যে নিজ নিজ পেশায় সফল অবদান রেখেছেন এমন ব্যক্তিদেরকে বিমান বন্দর থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাঁরা বর্তমানে বিরোধী দল বিএনপি’র সাথে সম্পৃক্ত। এরপরই এসেছে আরো বিস্ময়কর সংবাদ যে, সরকারের সেই অদৃশ্য উপরওয়ালারা বিমানবন্দরে ৭০ জন বিরোধী দলীয় নেতার নাম পাঠিয়েছেন যাতে এঁদেরকে বিদেশে যেতে দেওয়া না হয়। তাঁদের সাথে কয়েকজন পেশাজীবী, লেখক ও সাংবাদিকের নামও আছে যার মধ্যে আমাদের দু’জনেরও নামও যুক্ত করা হয়েছে বলে পত্রিকার রিপোর্টে আমরা দেখেছি। ঐ খবর প্রকাশিত হবার পর কয়েক দিন গত হলেও সরকারের তরফ থেকে সেটি সঠিক কি বেঠিক ঐ বিষয়ে কোন মন্তব্য করা হয়নি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রি শামসুল হক টুকু সেপ্টেম্বরের ১৯ তারিখে এই ধরণের প্রফাইলিং সম্পর্কে সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি এই ধরনের কোন তালিকার খবর জানেন না। তিনি ব্যাপারটি দেখবেন।
এভাবে আইনের বাইরে তালিকা প্রণয়ণ করে আমাদের যে গোপন প্রফাইলিং করা হয়েছে বলে খবরকাগজ মারফত আমরা জেনেছি, তা কোন সভ্য দেশের নজির হতে পারে না। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে হুমকি ও ভয় দেখিয়ে আমাদের কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা, আমাদের চিন্তা, বিবেক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন-নিপীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করে দেওয়া। এখানে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে এর আগেও আমরা লেখালিখির জন্য অগণতান্ত্রিক সরকারের নির্যাতন ভোগ করেছি। বিগত আমলে বিনপি সরকার ১৯৯৫ সালে আনসার বিদ্রোহের ওপর লেখার কারণে ফরহাদ মজহারকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করে, আদালতের নির্দেশে সরকার তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
এ ব্যাপারে আমাদের প্রথম বক্তব্য হলো যে, সরকার যেন তার অবৈধ পদক্ষেপ অবিলম্বে প্রত্যাহার করে। নাহলে আমরা বিদেশ যেতে চাইলে এই ধরনের বাধা পেলে আমাদেরকে অবশ্যই আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত,যারা ঐ তালিকা তৈরি করেছেন তারা সজ্ঞানেই চেষ্টা করেছেন ক্ষমতাসীন সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ, মানবাধিকার ও গণস্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ড এবং ক্রমাগত সমাজ ও রাজনৈতিক পরিবেশকে অস্থিতিশীল করে তোলা সম্পর্কে আমাদের ইতিবাচক সমালোচনা, পর্যালোচনা ও পরামর্শ উপেক্ষা করে আমাদেরকে তাঁদের অপছন্দের রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত প্রমাণ করতে এবং মানুষকে সেভাবে বোঝাতে। এই হীন চেষ্টা আমাদের কন্ঠস্বর মলিন করে দেবার এক পুরানা কৌশল অথচ আমরা কোন দলের সদস্য নই বা কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত নই। অতীতের অন্যান্য ক্ষমতাসীন সরকারকে আমরা যেমন সমালোচনা করেছি এই সরকারের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয় নি। সরকারের ও ক্ষমতাসীন দলের ভুল-ক্রটি-অন্যায়-অবৈধ কাজকর্মের সমালোচনা আমরা করি বলে সরকার পক্ষের আমাদেরকে বিরোধী দলের সাথে একাকার করে দিয়ে জনগণের পক্ষের লেখালেখি ও কথাবার্তাকে দুর্বল করে দেবার এই পদ্ধতি ন্যক্কারজনক। এটা করা হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে, আমাদেরকে তাঁদের সমর্থকবৃন্দের চোখে ঘৃণা ও সন্দেহের পাত্র করে তুলতে। তাঁরা ভুলে গেছেন যে, আমরা অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় তাদের অবৈধ, অগণতান্ত্রিক, অনিয়মতান্ত্রিক ও নিপীড়নমূলক কাজের প্রতিবাদ ও সমালোচনা যখনই প্রয়োজন তখনই করেছি। তার আগে জোট সরকারের আমলে আমরা একই কাজ করেছি। আমরা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থেকে দেশ ও জনগণের মঙ্গলের লক্ষ্যে আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষমতা নিবেদিত রেখেছি এবং ভবিষ্যতেও নির্ভয়ে রাখবো।
সারা দুনিয়ার সংবাদপত্র কর্মী, সাংবাদিক, লেখক-শিল্পী-সাহিত্যিক এবং সর্বোপরী মানবাধিকার কর্মীদের আমরা আহ্বান জানাচ্ছি তাঁরা যেন সরকারের মানবাধিকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ এবং বিদেশ গমনে বাধা দেবার জন্য তালিকা প্রণয়নের এই ঘৃণ্য তৎপরতাকে নিন্দা জানান। আমরা আশা করব লুকোচুরি না করে সরকার এই ধরণের তালিকা প্রত্যাহার করে গণতান্ত্রিক আচরণের নজির রাখবে।

৬ আশ্বিন ১৪১৬, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১০। ঢাকা।

ভাল নেই বাংলাদেশের শ্রমিক


মে ১, ২০১০
দেশের জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপি-তে শিল্প খাতের হিস্যা অথবা অবদান বৃদ্ধি পেয়েছে, একই সাথে বেড়েছে শ্রমিকের সংখ্যা। কিন্তু পিছু হটেছে শ্রমিক আন্দোলন। শ্রমিকরা সেই পঞ্চাশ বছর আগে যখন এই এলাকার নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান তখনকার মতো ন্যূনতম পারিশ্রমিকের দাবি তুলছেন। বেতন-ভাতা বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বেতন বৃদ্ধির হার ঠিক করা, জীবনযাত্রা সহনীয় করার জন্য চিকিৎসা সুবিধা ও সচেতন বাৎসরিক ছুটির ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি চাকরি বা কাজের নিশ্চয়তা বিধানের দাবি প্রকৃতপক্ষে আজও কথার কথা রয়ে গেছে। মে দিবস শ্রমিকদের দাবি আদায় করার সংগ্রামে রক্তদান ও প্রাণ বিসর্জনের স্মৃতিকে সম্মান দেখানোর দিন; উপলক্ষে একটা দিন ছুটি পাওয়া যাবে, কিছু লাল পতাকা উড়বে আকাশে, কয়েকটা অনুষ্ঠানও হবে কিন্তু বাংলাদেশে ঐ দিনটিতে যদি কোনো শ্রমিক উন্নতর জীবনের স্বপ্ন দেখেন তাহলে পরের দিন থেকে তাঁকে সেই কল্পনা মনের ভিতরে লালন করতে হবে। কারণ এ নিয়ে বেশি কথা বললে চাকরিটি চলে যাবে। এই মে দিবসের প্রাক্কালে দুই-চারজন শ্রমিক নেতার সাথে কথা বলে এই চিত্রটিই পেলাম।
কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ‘গত কয়েকদিন ধরে যে কাঁচপুর, মিরপুর ও গাজীপুরে পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের আন্দোলন, বিক্ষোভ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষের খবর দেখলাম তাতে তো এই শ্রমিকদেরকে অতো দুর্বল মনে হয় না।’ তার উত্তরে শুনতে হবে: ‘ঐ শ্রমিককরা কি কোনো স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য? তারা যে আন্দোলনে নেমেছে তা কি বকেয়া বেতনভাতার জন্য নাকি পারিশ্রমিক বৃদ্ধির জন্য? আন্দোলন ছিল বকেয়া বেতনের জন্য এবং কয়েক বছর আগে সরকার-ঘোষিত ন্যূনতম বেতন মাসিক ১৬৬২.৫০ (এক হাজার ছয়শত বাষট্টি টাকা পঞ্চাশ পয়সা) হারে পাবার জন্য। বকেয়া বেতনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন তাদের পেট ও পিঠ একখানে হয়ে গেছে এবং ঘরভাড়া দিতে না পারায় যখন ঘর থেকে উৎখাত হবার জোগাড় হয়েছে কেবল তখন তারা রাস্তায় মিছিল বের করেছে।’
একই সাথে লক্ষণীয়, তৈরী পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিলেই বা উত্তেজিত হয়ে কারখানায় ভাঙচুর করলেই শোনা যায় যে, এসবের পিছনে বিদেশী ষড়যন্ত্র আছে, গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করে বেকারত্ব সৃষ্টি করে এবং রপ্তানী আয় বন্ধ করে দিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। তাই শিল্পপুলিশ বাহিনী সৃষ্টি করবে সরকার। একই সাথে প্রস্তাব আছে যে, শিল্প বিচার ব্যবস্থা (ইন্ডাস্ট্রিয়াল জুডিশিয়ারি) সৃষ্টি করা হবে এবং সেটিকে দেওয়ানী আদালতের আওতায় আনা হবে। পোশাক শ্রমিক সংগঠন, গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরাম নেত্রী মোশরেফা মিশু বললেন, ‘শ্রম আদালত তুলে দিয়ে তা যদি দেওয়ানী আদালতের সাথে সংযুক্ত করা হয় তাহলে শ্রমিকদেরকে কোর্টের বারান্দাতেই পড়ে থাকতে হবে। বিচার তারা পাবে না। কারণ দেওয়ানী আদালতের মামলা দশ-পনের বছরেও নিষ্পত্তি হয় না।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) নেতা হায়দার আকবর খান রনো জানালেন যে, ‘গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে বাস্তবে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন হতে দিচ্ছেন না মালিকরা। অথচ তাঁরা বুঝতে চাচ্ছেন না যে তাদের শিল্পের স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে অনেক কিছুই আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হতো এবং অশান্তি হতো না।’
বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এতক্ষণ ধরে পোশাক শিল্পে তাদের পরিস্থিতির কথা বললাম এজন্য যে, গার্মেন্টস কর্মীরা আমাদের কাছে সবচেয়ে দৃশ্যমান। এই শিল্পে ৩০ লক্ষাধিক শ্রমিক কাজ করেন। এদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগ, অর্থাৎ ২৪ লক্ষই নারী শ্রমিক। আমাদের আশপাশ দিয়ে যখন এই নারী শ্রমিকরা যাওয়া-আসা করেন লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন যে, তাদের বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভুগছেন। পোশাকে-আশাকেও এরা খুব দীনহীন। প্রায় সবার পায়ে থাকে রবারের চপ্পল, জুতো পরেনই না এঁরা।
বাংলাদেশে আরো বহু শ্রমিক আছেন। এঁদের সংখ্যা আড়াই কোটি থেকে তিন কোটির মধ্যে হবে বলে অনুমান করা হয়। এঁরা কাজ করছেন সড়ক ও জনপথ, নির্মাণ, বস্ত্র (সূতা তৈরি ও বুনন), ট্যানারি, জাহাজ ভাঙা, পোল্ট্রি ও চিংড়ি (প্রক্রিয়াজাতকরণ), চাতাল (ধান কল), ও কৃষি খাতে। এর সাথে সেবা খাত যোগ করলে তার মধ্যে আসবে দোকান-শ্রমিক এবং যানবাহন মেরামত কারখানার শ্রমিকগণ। নির্মাণ খাতের অন্তর্ভুক্ত করা যায় পাথর উত্তোলন ও পাথর ভাঙার এবং ইট ভাটার শ্রমিকদের। এঁরা অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এঁরা মানবেতর পরিবেশে কাজ করেন। এদের মধ্যে বহু নারীশ্রমিক আছেন। পোশাক শিল্পের বাইরে মেয়েদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় নির্মাণ (মাটি কাটা ও ইট ভাঙার কাজে মূলত), চাতাল ও মাছ প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে।
এদের সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, (১) বহু মানুষ শ্রমিক হিসাবে কিছু আয় করছেন, (২) এঁদের আয় খুব কম, যা দিয়ে দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব নয়, (৩) এঁদের অনেকেই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করেন এবং (৪) এঁদের বেশিরভাগই অসংগঠিত অর্থাৎ না আছে তাঁদের নির্ধারিত বেতন-ভাতা, না পান তাঁরা কোনো নিয়োগপত্র আর না তাঁরা কোনো ট্রেড ইউনিয়ন বা সমিতির সদস্য।
আরেকটি কথা, পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে শ্রমিকদের যে রাজনৈতিক ভূমিকা ছিল এখন তেমন দেখা যায় না।